ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

আলীকদমে বাঁশের কঞ্চি আর লাউলের খোলে ম্রো বাঁশি "প্লুং" তৈরি করেন ম্রো সম্প্রদায়

সুশান্ত কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাঁ আলীকদম(বান্দরবান)প্রতিনিধি | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৪:৫৭:০০ অপরাহ্ন | বিনোদন
বান্দরবানের আলীকদমে ম্রো জনগোষ্ঠীর লোকজন বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে শিশু ও বয়োবৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই একপ্রকার বিশেষ বাঁশির সুর ও ছন্দের তালে নৃত্য পরিবেশন করে থাকে দল বেঁধে। বিশেষ কোন উৎসব হলে আর কথাই নেই। গভীর রাত পর্যন্ত চলে ক্লান্তিহীন ভাবে একটানা এই নাচ-গান। 
 
গো হত্যা উৎসবের মতো বিশেষ কোন অনুষ্ঠান হলে রাতভর চলে নৃত্যর তালে তাল দিয়ে থাকে যে বাঁশির সুর, ম্রো জনগোষ্ঠীর ভাষায় সে বাঁশির নাম হল 'প্লুং'। একটি লাউয়ের খোল আর কয়েকটি বাঁশের কঞ্চি মিলে তৈরি হয়ে থাকে ম্রোদের এই " প্লুং"। একটি লাউয়ের খোলকে দু'পাশে ছিদ্র করে কোনোটায় চারটি আর কোনোটায় ছয়টি বাঁশির কঞ্চি দিয়ে তৈরি করা হয়। বিভিন্ন উৎসব-পার্বনে এ 'প্লুং' বাঁশির সুরের তালে ও ছন্দে রাতভর আনন্দে মাতেন তারা। 
 
আলীকদম ৪নং কুরুকপাতা ইউপি চেয়ারম্যান ক্রাত পুং ম্রো জানান, প্লুং বা বাঁশি নিয়ে ম্রো সম্প্রদায়ের মধ্যে দুটি প্রচলিত কাহিনি রয়েছে। একসময় মহামারি হিসাবে পরিচিত পাওয়া কলেরা রোগ নিয়ে এ দুটি কাহিনি। কোনো এক সময় পাহাড়ে উপর একটি ম্রো গ্রাম ছিল। একদিন হঠাৎ করে এ গামে সবাই কলেরায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তার মধ্যে অনেক জন মারা যায়। অনেকেই মূমুর্ষ অবস্থায় ছিল। সে সময় কবিরাজির সেবা-শুশ্রুষা ও দেবতাদের পূজা দিয়েও প্রতিকারের উপায় না পেয়ে সকলেই অসহায় হয়ে পড়ে। তার মধ্যে গ্রামের সবচেয়ে এক প্রবীণ ব্যক্তি একদিন স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নে এক সন্যাসী তাকে বলে একটি লাউয়ের খোল সংগ্রহ করে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে মৌচাকের মোম দিয়ে একটি বাঁশি তৈরি করতে। সে বাঁশি বাজিয়ে গোটা গ্রামে সাতবার প্রদক্ষিণ করলে সবাই সুস্থ হয়ে যাবে। 
 
পাড়াবাসীকে সে স্বপ্নের কথা বলা হলে অবিশ্বাস করে সবাই তাকে হাসাহাসি ও তাচ্ছিল্য করত। কিন্তু পাড়ার সে প্রবীণ ব্যক্তি দমে না গিয়ে স্বপ্নে পাওয়া সন্ন্যাসীর কথামত লাউয়ের খোল ও বাঁশের কঞ্চি দিয়ে একটি বাঁশি তৈরি করলেন। আর সে বাঁশি বাজিয়ে গ্রামের চারদিকে সাতবার প্রদক্ষিণ করার পর কলেরা আক্রান্ত সবাই সুস্থ হয়ে যায়। এরপর থেকে এ বাঁশির নাম 'রিনা প্লুং নামে পরিচিত হয়। রিনা মানে কলেরা আর 'প্লুং' হল বাঁশি।
 
অন্যদিকে প্লুং বাঁশি নিয়ে আরেকটি কাহিনি পাওয়া যায় ২০১৯ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশ হওয়া বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য ও লেখক সিংইয়ং ম্রোর লেখা 'ম্রো জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতি' বইতে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, অনেক দিন আগে হঠাৎ ম্রো অধ্যুষিত এলাকায় মহামারি কলেরা রোগের প্রদুর্ভাব দেখা দেয়। এতে বহু লোক মারা যায়। এসময় এক ম্রো যুবক কলেরা আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার পর তাকে শশ্মানে নিয়ে যাওয়ার সময় অলৌকিকভাবে সে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠে এমন ছিল সে কাহিনি। 
 
জীবন ফিরে পাওয়ায় তাকে আর দাহ করা হল না। আর বাড়ি ফিরে ম্রো যুবকটি জাহাজের পাওয়া বাঁশির মত হুবহু বাঁশি তৈরি করলেন। এরপর থেকে ম্রোদের এই বাঁশির নাম রিনা প্লুং বা কলেরা বাঁশি নামে পরিচিতি পায়। তবে রিনা প্লুং শুধুমাত্র গানের আসর এবং যুবক-যুবতীদের আনন্দ-উল্লাস করার মূর্হতে বাজানো হয় বলে 'ম্রো জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতি' বইয়ে উল্লেখ করেন লেখক সিংইয়ং ম্রো।
 
ম্রো বাঁশি সম্পর্কিত এ দুটি কাহিনি ঠিক কত সময়ের আগে কথা জিজ্ঞেস করা হলে আলীকদম মুরুং কল্যাণ ছাত্রাবাস পরিচালক ইয়ংলক ম্রো বলেন,এখনও পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট সময় কাল পাওয়া যায়নি,তবে অনেক বয়োজ্যেষ্ঠদের মাধ্যমে জানলাম অন্তত পাঁচ-ছয়শ বছর আগের কোন এক সময়কার কাহিনি হবে। এ দুটি কাহিনি এখনও বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন রাজ্যে অবস্থানরত ম্রোদের মুখে মুখে ঘোরে। তবে দুর্গম এলাকার ম্রো জনগোষ্ঠীদের অনেকেই এখনও ম্রো বাঁশি তৈরি করে থাকে। কিন্তু হাতের দক্ষতা না থাকলে ভাল ভাবে সুর ফুটে উঠবে না।
 
এই বাঁশি বানানোর পদ্ধতি সম্পর্কে কারিগর চিংতুই ম্রো বলেন, ছোট বাঁশি তিন থেকে ছয় ইঞ্চি পর্যন্ত তৈরি করা হয়। মাঝারি সাইজের বাঁশি তৈরি করা হয় বার, চব্বিশ, ছাব্বিশ ও বিলাল্লিশ ইঞ্চি পর্যন্ত। এছাড়া সবচেয়ে বড় বাঁশি তৈরি করা হয় ১৮ ফুট পর্যন্ত। বড় সাইজের বাঁশির সুর অনেক দূর থেকেও শুনা যায়। সবগুলো একসাথে বাজালে মনে হবে পাহাড় কেঁপে উঠে।
 
''শুকনো লাউয়ের খোলকে দুই পাশে ছিদ্র করে পাঁচটি অথবা ছয়টি ছোট বাঁশের কঞ্চি ঢুকিয়ে মৌচাকের মোম দিয়ে আটকনো হয়। লাউয়ের খোলে প্রধানমুখে আটকানো বাঁশের কঞ্চি দিয়ে মুখে বাতাস দিলে ভেতরে কম্পন তৈরি হয়ে শব্দ সৃষ্টি হয়। আর প্রত্যেক বাঁশের কঞ্চিতে একটি করে ফোটা থাকে। এসব ফোটায় হাতের আঙ্গুল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তৈরি হয় বিভিন্ন সুর ও ছন্দ।''
 
লাউয়ের খোল ও বাঁশের কঞ্চি প্রক্রিয়া করতে সময় লাগে। এগুলো একসঙ্গে পেলে ছোট সাইজের বাঁশি একদিনে কয়েকটি বানানো যায় জানিয়ে কারিগর চিংতুই ম্রো আরও বলেন, প্রত্যেক বাঁশির একেকটি নাম রয়েছে। প্লুং কাকমা, প্লুং ক্লাং,তিংতেং প্লুং, ত্র, রিনা প্লুং ও পুরুই ইত্যাদি। নৃত্যের বাঁশি,কলেরা বাঁশি (রিনা প্লুং),গো হত্যা বাঁশি এবং উৎসব-পার্বন উপলক্ষে বাজানোর জন্য আলাদা করে বাঁশি রয়েছে। প্রত্যেক দলের একসেটে চব্বিশটি বাঁশি থাকবে। সর্বনিম্ন চৌদ্দটি বাঁশি লাগে। এর চাইতে কম হলে সুর পরিপূর্ণ হয় না।
 
ম্রো গানের শিল্পী প্রেনপ্রে ম্রো বলেন, বিভিন্ন উৎসব পার্বন ও সামাজিক অনুষ্ঠানে প্লুং বাজানো হলেও ম্রোদের গো হত্যা অনুষ্ঠান ও নববর্ষে চাংক্রান উৎসবে এ বাঁশির সুর জমে উঠে। বলিদানের অনুষ্ঠানে এই বাঁশির সুরে রাত ভর নাচ চলে। তখন পালাক্রমে বিভিন্ন দল বাঁশির সুরে ছন্দ মিলিয়ে নাচে। একেকটি দলে থাকে অন্তত সাত থেকে পনের জনের সদস্য।
 
নৃত্য দলের শিশু ও মেয়েদের গলায় থাকে রুপার মালা আর পায়ে থাকে নুপুর। গভীর রাতে রুপার মালা ও নুপুরের শব্দ আর সেই বিশেষ বাঁশির সুর একাকার হয়ে ছড়িয়ে পড়ে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে। এসব সুর শুনলে তখন মনের মধ্যে অন্যরকম ভালো লাগার অনুভূতি কাজ করে বলে জানা গেছে।