ঢাকা, শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ৩রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ঢাকা-দিল্লি-কাঠমান্ডুর ঐতিহাসিক বিদ্যুৎ চুক্তি জুলাইতেই

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | প্রকাশের সময় : শনিবার ১ জুলাই ২০২৩ ০১:৪৪:০০ পূর্বাহ্ন | অর্থনীতি ও বাণিজ্য

 

 

ভারতের পাওয়ার গ্রিডকে ব্যবহার করে নেপালে উৎপাদিত জলবিদ্যুৎ যাতে বাংলাদেশে আসতে পারে, সেই লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক ত্রিপাক্ষিক চুক্তি খুব শিগগিরই সই হতে চলেছে। দিল্লিতে সরকারি কর্মকর্তারা  আভাস দিয়েছেন, সব কিছু ঠিকমতো এগোলে জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ সংশ্লিষ্ট তিন দেশের মধ্যে চুক্তিটি সম্পাদিত হয়ে যাবে। 

 

বস্তুত বাংলাদেশ ও নেপাল বেশ কিছুকাল আগেই এই বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়ে নিজেরা নীতিগতভাবে একমত হয়েছিল। তবে এ ব্যাপারে অপেক্ষা ছিল ভারতের সম্মতির। বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে যেহেতু সরাসরি কোনও সীমান্ত নেই, তাই ভারতের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভবও নয়। কিন্তু এখন যাবতীয় দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসানে ভারতও এই প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। ফলে ত্রিপাক্ষিক চুক্তির সম্পাদনে এখন আর বিশেষ কোনও বাধা নেই। 

 

 

বাংলা ট্রিবিউন জানতে পেরেছে, নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকুমার দাহাল (ওরফে প্রচন্ড) যখন এ মাসের গোড়ায় ভারত সফরে আসেন, তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার আলোচনায় প্রসঙ্গটি উঠেছিল। সেই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রচন্ডকে কথা দিয়েছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ‘বৃহত্তর এনার্জি কানেক্টিভিটি’র স্বার্থে ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশকে তাদের পাওয়ার গ্রিড ব্যবহার করার অনুমতি দেবে।

 

 

ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই আশ্বাস মেলার পর চুক্তি সম্পাদনের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। নেপালের বিদ্যুৎ সচিব দীনেশ কুসার ঘিমির জাপানের নিক্কেই বার্তা সংস্থাকেও এমনটা জানিয়েছেন। তিনি জানান, চুক্তি সম্পাদনের পর শুরুতে তারা বাংলাদেশকে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবেন। কিন্তু মাত্র এক বছরের মধ্যেই এর পরিমাণ বাড়িয়ে ৫০০ মেগাওয়াট করা যাবে বলেও তারা আত্মবিশ্বাসী।

 

ভারতে পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ ও শাসক বিজেপির ঘনিষ্ঠ তাত্ত্বিক শুভ্রকমল দত্ত বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘এই চুক্তিতে তিন দেশই যে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে, তার কারণ তিনটি দেশই উপলব্ধি করেছে এটা সবার জন্যই একটা উইন-উইন সিচুয়েশন।’

 

আসন্ন এই ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে কীভাবে তিনটি দেশেরই লাভ হবে, সেটারও বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।

 

হিমালয়ে উৎপন্ন হওয়া খরস্রোতা নদীগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ জলবিদ্যুৎ তৈরির সম্ভাবনা থাকলেও তার খুব অল্প অংশই নেপাল সদ্ব্যবহার করতে পেরেছে। এই জলশক্তির বেশিভাগই এখন অপচয় হচ্ছে। কিন্তু ভারতীয় পাওয়ার গ্রিডের মাধ্যমে নেপাল যদি বাংলাদেশে জলবিদ্যুৎ রফতানির সুযোগ পায় তাহলে সে দেশের বিদ্যুৎ খাতে অবশ্যই বিনিয়োগ বাড়বে, লগ্নিকারীরা আগ্রহ দেখাবেন। কারণ সেই বিদ্যুতের একটা নিশ্চিত বাজার থাকবে। প্রযুক্তিগত ক্যাপাসিটি বা অর্থবলের অভাবে নেপালে আজ যে বড় বড় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না সেটা তখন অনায়াসেই করা যাবে। নেপালে কর্মসংস্থান হবে, শিল্পবান্ধব পরিবেশ তৈরি হবে।

 

ভারতের লাভ

 

নেপালে বড় বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ড্যাম (বাঁধ) তৈরি করে হিমালয়ে উৎপন্ন নদীগুলোর জলসম্পদ যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় তাহলে ভারতের সবচেয়ে বড় লাভ হলো বিহার ও উত্তরপ্রদেশের মতো গাঙ্গেয় সমতলের রাজ্যগুলো প্রতি বছরের ভয়ঙ্কর বন্যা থেকে মুক্তি পাবে। কোশী বা গন্ডকের মতো নেপালের নদীগুলো প্রতি বছর জুলাই-আগস্টে বিহার-উত্তরপ্রদেশে বন্যার কারণ হিসেবে দেখা দেয়। কারণ সেগুলোতে সঠিক ‘ওয়াটার ম্যানেজমেন্টে’র অভাব আছে। এছাড়া ভারতের পাওয়ার গ্রিড ব্যবহার করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলে ভারত ট্রান্সমিশন ফি থেকেও লাভবান হবে।        

 

বাংলাদেশের লাভ

 

বাংলাদেশে এই মুহুর্তে যে এনার্জি সঙ্কট চলছে এবং প্রতি বছরই বিদ্যুতের চাহিদা যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তাতে নেপাল থেকে বাড়তি ৫০০ বা ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এলে তা সঙ্কট মোকাবিলায় বেশ সাহায্য করবে। তা ছাড়া সারা পৃথিবীতেই জলবিদ্যুতের দাম তাপবিদ্যুৎ বা অন্যান্য সাবেকি উৎস থেকে তৈরি বিদ্যুতের তুলনায় কম হয়ে থাকে। ফলে আশা করা যায় নেপালের বিদ্যুতের দাম গোড্ডা, পায়রা বা রামপালের চেয়ে কম পড়বে। আন্তর্জাতিক কোনও কারণে কয়লার সরবরাহ বিঘ্নিত হয়ে সম্প্রতি যেভাবে নানা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ বন্ধ করে দিতে হয়েছে, জলবিদ্যুতের ক্ষেত্রে সেই ভয়টাও নেই। সোজা কথায়, এই বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জন্য নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী সরবরাহ নিশ্চিত করবে। 

 

৫০

শুভ্রকমল দত্ত

ড. শুভ্রকমল দত্ত আরও মনে করেন, বাংলাদেশ-নেপাল-ভারতের মধ্যে এই ত্রিপাক্ষিক চুক্তি সফলভাবে সম্পাদিত হলে তা বাংলাদেশ-ভারত-ভুটানের মধ্যেও অনুরূপ চুক্তির পথ প্রশস্ত করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পার্বত্য দেশ ভুটানেও অন্তত ৫০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা আছে – যার মাত্র ১০ শতাংশ এখন রূপায়িত হচ্ছে। 

 

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের ভেড়ামাড়া থেকে পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর পর্যন্ত যে হাই-ভোল্টেজ সংযোগ লাইন আছে, সেই রুটকে ব্যবহার করে কীভাবে নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আনা সম্ভব, দুই দেশের পাওয়ার বোর্ড সেই পরিকল্পনাও ছকে ফেলেছে। ভারতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এনটিপিসি-র যে শাখাটি আন্তর্জাতিক বিদ্যুৎ বাণিজ্যের দিকটি দেখাশোনা করে, সেই এনটিপিসি বিদ্যুৎ ব্যাপার নিগম-ও এই পরিকল্পনায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছে।