ঢাকা, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

শত বছর ধরে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে নাটোর ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরী

ফরহাদুজ্জামান, নাটোর : | প্রকাশের সময় : সোমবার ৬ ডিসেম্বর ২০২১ ০৭:২৯:০০ অপরাহ্ন | সাহিত্য

শত বছরের অধিক সময় ধরে বই পিপাশু মানুষদের জ্ঞানের পিপাসা মিটিয়ে আসছেন নাটোরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরী। বহু খ্যাতনামা লেখকদের পদচারণায় মুখরিত ছিল এই প্রাচীন প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরামর্শে ১৯০১ সালে সাহিত্যিক ও শিক্ষানুরাগী নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্র নাথ প্রতিষ্ঠা করেন ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরি।  

 

প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এ লাইব্রেরি হয়ে ওঠে শিক্ষিত সচেতন গণমানুষের প্রিয় পাঠস্থান। রাজা, জমিদার ও শিক্ষিত এলিট শ্রেণীর আনুকুল্যে গড়ে ওঠে ধনাঢ্য সংগ্রহশালা। অক্ষয় কুমার মৈত্র ও রায় বাহাদুর জলধর সেন পালন করেন বই নির্বাচনের দায়িত্ব। স্যার যদুনাথ সরকার, প্রমথ নাথ  বিশি’র মত বরেণ্য ব্যক্তিদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে লাইব্রেরি আঙ্গিনা।

ত্রিশের দশকে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ কাজী আবুল মসউদ ও লেখক গোবিন্দ সাহার মত ব্যক্তিদের গতিশীল নেতৃত্বে  লাইব্রেরিটি হয় সমৃদ্ধ। নিয়মিত আয়োজন হতে থাকে পূর্ণিমা তিথিতে বিশেষ সাহিত্য সভা। বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য সভায় অতিথি হয়ে আসেন কথা সাহিত্যিক তারা শংকর বন্দোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় এবং যুগান্তর সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, আনন্দবাজার সম্পাদক চপলাকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ। 

 

’৪৭-এর ভারত বিভক্তির শূণ্যতার পর ষাটের দশকে লাইব্রেরি পুনরায় প্রাণ ফিরে পায়। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয় এ লাইব্রেরিটি। আশির দশকে এসডিও এ,এইচ,এস সাদেকুল হকের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং কথা সাহিত্যিক শফী উদ্দিন সরদারের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে প্রাণ ফিরে আসে লাইব্রেরির। আর ১৯৮৬ সালে জেলা প্রশাসক জালাল উদ্দিন আহামেদ এর আন্তরিক প্রচেষ্টায় বিদ্যমান নতুন ভবনের নির্মান কাজের মধ্য দিয়ে লাইব্রেরির নতুন যাত্রা শুরু হয়। পাঁচ শতাংশ জমির উপর নির্মাণ করা ত্রিতল ভবন। 

পাঠক সমাগমে ভরপুর নব্বই এর দশক ছিল লাইব্রেরির সোনালী সময়। বিভিন্ন দিবস উদযাপন, সাহিত্য আসর আয়োজন, দেয়াল পত্রিকার প্রকাশনা ছিলো চোখে পড়ার মত। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এককভাবে আয়োজন করা হয় একুশের বই মেলার। এক্ষেত্রে দক্ষ সংগঠকের স্বাক্ষর রেখেছেন আলী আশরাফ নতুন ও মরহুম রশীদুজ্জামান সাদী।

কালের পরিক্রমায় বর্তমানে লাইব্রেরিতে এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা, বাংলাপিডিয়া, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসহ ১২ হাজার বই রয়েছে। জেলা প্রশাসনের সাথে যৌথভাবে একুশের বইমেলা আয়োজন ছাড়াও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস, বিজয় দিবস উদযাপন ছাড়াও অনিয়মিত আয়োজনে রয়েছে সাহিত্য আসর।

 

প্রতি বছর ডিসেম্বরে আলোচনা-সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে বার্ষিক সাধারণ সভাটি। গত বার্ষিক সাধারণ সভাতে পাঠকদের লাইব্রেরিমুখী করতে অংশগ্রহণকারীদের প্রস্তাবনায় উঠে আসে বেশ কিছু প্রস্তাবনা। এরমধ্যে ই-বুক চালু ও শিক্ষার্থীদের জন্যে বইপড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন উল্লেখযোগ্য। নির্বাহী কমিটিতে একই মুখের আগমন না ঘটিয়ে নতুন মুখ সংযোজন ও কমিটির মেয়াদ তিন বছর থেকে কমিয়ে দুই বছর করার প্রস্তাবও দেয়া হয়।

বর্তমানে লাইব্রেরিটি পদাধিকার বলে সভাপতি জেলা প্রশাসক। তবে সহ সভাপতি সাধারণ সম্পাদক সহ অন্যান্য পদসরাসরি সদস্যদের ভোটে নির্ধারিত সময়ের জন্য নির্বাচিত হন। বর্তশানে ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরীর সাধারণ সম্পাদক বলেন, করোনার প্রভাবে লাইব্রেরিটির কার্যক্রম থমকে গিয়েছিল। তবে এখন আবার নতুন করে লাইব্রেরিটি চালু করা সহ পাঠক বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে । এছাড়া সাহিত্য আলোচনা সহ নানা ধরণর সাষ্কংৃতিক কার্যক্রম হাতে নেওয়া হচ্ছে। যাতে করে লাইব্রেরীটির পুরোনা ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা যায় সে বিষয়ে বর্তমান কমিটি তৎপর রয়েছে।তবে ইন্টারনেট ও মোবাইল প্রযুক্তির প্রভাবে লাইব্রেরীর পাঠক সংখ্যা কমেছে বলে তিনি মনে করেন।  

 

 

নিয়মিত পাঠক কবি গনেশ পাল বলেন, পড়ার নেশা থেকেই আসা। পাঠক না আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা এখন পাঠ্য বই এর চাপে অস্থির, রয়েছে কোচিংয়ের চাপ। ওদের আর সময় নেই। মুহাম্মদ রবিউল হক বই এর সংগ্রহ আরো বৃদ্ধির পরামর্শ দেন।

 

লাইব্রেরির আজীবন সদস্য মুজিবুল হক নবী নিয়মিত লাইব্রেরিতে না আসা প্রসঙ্গে বলেন, ব্যস্ততা। ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা এবং ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ের কারণে লাইব্রেরিতে পাঠক থাকছে না।

 

লাইব্রেরী পরিচালনা কমিটির সদস্য খগেন্দ্রনাথ রায় বলেন 

আগের চেয়ে বই পড়ার প্রবনতা মানুষের কমেছে। এর কারণ হিসেবে তিনি ডিশ লাইনে টেলিভিশন, ইন্টারনেট ,মোবাইল কম্পিউটার ও ফেসবুক ও ইউটিউব প্রভাব ফেলছে বলে তিনি মনে করেন। একই সাথে তিনি বলেন,যথার্থ জ্ঞান অর্জনের জন্য বইয়ের কোন বিকল্প নেই। করোনার প্রভাব কমে গেলে লাইব্রেরী আবার জমজমাট হয়ে উঠবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।