ঢাকা, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১
বাতিল হচ্ছে মৎস্যমন্ত্রী ও এমপি ফারুক খানের স্বীকৃতি

সবাই হতে চান মুক্তিযোদ্ধা

নিজস্ব প্রতিবেদক: | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ২৬ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৩০:০০ পূর্বাহ্ন | এক্সক্লুসিভ

 

 

দেশের জন্য যুদ্ধ না করেও জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিলেন বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু। বীর মুক্তিযোদ্ধার সরকারি সুযোগ-সুবিধা বাগাতে নিজ পিতা জসমতুল্লাহর নাম বদলে মশমতুল্লাহ করেন। ক্ষমতার দাপটে ২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারি যাচাইবাছাইকালে আদমদীঘির প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা মজিবরকে বাদ দিয়ে তার লাল মুক্তিবার্তা নম্বর (৩০৬০৯০১২১) ব্যবহার করে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু মুক্তিযোদ্ধা বনে যান। কিন্তু বিধিবাম, ধরা খান জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) শুনানিকালে। গত ১০ মার্চ মজিবর রহমানের (মজনু) ১৮৬৩ নম্বর বেসামরিক গেজেট ও সনদ বাতিল করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। শুধু তাই নয়, সারা দেশের এ ধরনের ৮১ জন অ-মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিল করা হয়েছে।

 

এ ছাড়া মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান এমপির মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিল হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। তাদের স্বীকৃতি নিয়ে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠায় পুনঃযাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামুকা। বিষয়টি পরিষ্কার করতে ও জামুকার ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে শ ম রেজাউল করিমের সঙ্গে কথা বলবে তারা। আর প্রকৃত সত্য উদঘাটনের স্বার্থে ফারুক খানের বিষয়ে সেনা সদরের মতামত  চেয়ে চিঠি দিয়েছে জামুকা। সেনা সদরের মতামত পাওয়ার পরই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।

 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জামুকার চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গতকাল  বলেন, ‘আমরা ৭৮তম সভায় ৮১ জন অ-মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত হওয়ায় তাদের সনদ ও গেজেট বাতিলের সুপারিশ করেছি। এ ছাড়া মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান এমপির মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠায় পুনঃযাচাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিষয়টি পরিষ্কার ও জামুকার ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে শ ম রেজাউল করিমের সঙ্গে কথা বলা হবে। আর প্রকৃত সত্য উদঘাটনের স্বার্থে ফারুক খানের বিষয়ে সেনা সদরের মতামত চেয়ে চিঠি দিয়েছে জামুকা। তাদের মতামত পাওয়ার পরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘মৎস্যমন্ত্রীর বিষয়টি মহামান্য আদালতের নির্দেশনার কারণে দিতে হয়েছে। আদালতের মতে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স জিজ্ঞাসা করা যাবে না।’

জামুকা সূত্র জানায়, গত বছরের ১৫ জুন জামুকার ৭৫তম সভায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাঁর জন্ম ১৯৬২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। সে হিসাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় তাঁর বয়স ১০ বছরের কম ছিল। অথচ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে ন্যূনতম বয়স হতে হয় সাড়ে ১২ বছর। তাহলে রেজাউল করিমকে কীভাবে এ স্বীকৃতি দেওয়া হলো? বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠার পর বিষয়টি নতুন করে যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামুকা। একই সঙ্গে কমিটি তাঁর সঙ্গে কথা বলারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চেয়ে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে জামুকার ৭২তম সভায় ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়। তবে তাঁর স্বীকৃতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় জামুকা সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের স্বার্থে ফারুক খানের বিষয়ে সেনা সদরের মতামত নেওয়া হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জামুকার সদস্য মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীরপ্রতীক  বলেন, ‘এগুলোর বিষয়ে আমি জোর আপত্তি দিলেও জামুকার অন্য সদস্যরা আমলে নেননি। তারা ক্ষমতাসীন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দেয়। আমি জোর দিয়ে বলেছি-মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ২৩ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়ন ভারতীয় সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ওই ব্যাটালিয়নে ছিলেন ফারুক খান। নিজে বাঙালি অফিসার পরিচয় দিয়ে কোনোমতে জানে রক্ষা পান। ভারতীয় সেনারা ১৫ ডিসেম্বর তাকে দিল্লি পাঠান। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে ফারুক খানকে কলকাতার বাংলাদেশ হাইকমিশনার হোসেন আলীর দফতরে পাঠানো হয়। সেখানে এক মাস ঘোরাঘুরি করে ১৪ জানুয়ারি বেনাপোল বন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তাহলে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করলেন কখন? বরং পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করে ধরা খান তিনি। এসব বলার পরও তারা কোনো তোয়াক্কা করেননি। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সিদ্ধান্ত চেয়ে সারসংক্ষেপ পাঠালে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দেননি। অথচ তার আগেই এই দুজনের গেজেট জারি করে মন্ত্রণালয়। এ ধরনের ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মহত্যার শামিল। দেখা যাক তাদের ব্যাপারে নতুন করে কী সিদ্ধান্ত আসে। প্রয়োজনে আমি আবারও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেব।’ জানা গেছে, বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী পালন করছে তখন বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে আবেদন করেন ক্ষমতাসীন দলের দুজন সিনিয়র সংসদ সদস্য। তাঁরা হলেন গোপালগঞ্জ-১ আসনের এমপি ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান এবং ঢাকা-১১ আসনের এ কে এম রহমতুল্লাহ। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খাজা মিয়া তাঁর প্রয়াত বাবা সোহরাব হোসেনের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে আবেদন করেন। এই তিনজনের মধ্যে ফারুক খানের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত করতে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জামুকার ৭২তম সভায় সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তাঁর নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির জন্য আবেদন করলে তা জামুকার বিশেষ উপকমিটিতে পাঠানো হয়। আবেদনটি পর্যালোচনা করে উপকমিটি পর্যবেক্ষণ দেয় তিনি ‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণিত নন’। একই উপকমিটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব খাজা মিয়ার বাবা সোহরাব হোসেনকেও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে জামুকার গত ৭৮তম সভায় ৮১ জনের গেজেট ও সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। তাদের বিষয়ে বলা হয়েছে, যাদের শুধু গেজেট রয়েছে তাদের গেজেট বাতিল; যাদের শুধু সনদ রয়েছে তাদের সনদ বাতিল; যাদের লাল মুক্তিবার্তা আছে তাদের লাল মুক্তিবার্তা বাতিল এবং যাদের গেজেট, সনদ ও লাল মুক্তিবার্তা রয়েছে তাদের গেজেট, সনদ ও লাল মুক্তিবার্তা বাতিল করা হবে। এরপর গত ১০ মার্চ তাদের গেজেট ও সনদ বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। উল্লিখিত মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসার পর ২০২০ থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দুই দফা শুনানি গ্রহণ করা হয়েছে। এসব শুনানিতে উপস্থিত হয়েও তারা অভিযোগ খণ্ডন করে মুক্তিযোদ্ধার সপক্ষে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস ও সহযোদ্ধাদের সাক্ষী হাজির করতে পারেননি। তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্য, কিন্তু সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। অথচ তাদের অধিকাংশই গত দুই দশক ধরে নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা এবং সরকারি চাকরিতে সন্তান-পোষ্যদের জন্য নির্ধারিত কোটার সুবিধাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন।

 

বাতিল হলো যাদের মুক্তিযোদ্ধার সনদ : দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের মো. আফতাব উদ্দীন, মো. ইসমাইল; খুলনার ডুমুরিয়ার নিখিল চন্দ্র মণ্ডল, প্রভাষ চন্দ্র ফৌজদার; সাতক্ষীরার আলিপুরের মো. আবদুল করিম সরদার, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের সরোয়ার হোসেন, হাবিলদার রুস্তম আলী, মো. তৈয়বুর রহমান, হাফিজুর রহমান কাশেম, আসাদুজ্জামান, শেখ মজিবুর রহমান; নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মো. মতিউর রহমান, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার মোহাম্মদ মতিউর রহমান সরকার, ভৈরব বাজারের মো. ফজলুল হক; গাজীপুরের কালিগঞ্জের সিরাজুল হক মোড়ল, নাজির উল্লাহ মোল্লা, শহীদ আবদুল কাদির শেখ, মো. আহসান উল্লাহ, অনল রিবেরু, মন্টু গোমেজ, কাপাসিয়ার মো. আবদুল হাই, শ্রীপুরের মো. সামসুল হক, মো. আছিম উদ্দিন, সদরের মো. সাইয়েদুল হক মোল্লা; চট্টগ্রামের পটিয়ার রণজিত কুমার দাশ, সাতকানিয়ার হাফেজ আহমদ, বাবুল কান্তি দাশ, কুমিল্লার দেবিদ্বারের মৃত আবদুল কাদের, ফেনীর ছাগলনাইয়ার ছিদ্দিক উল্লাহ, ভোলার বোরহানউদ্দিনের মো. আহম্মদ উল্লা, মো. আ. মান্নান; বরগুনার বামনার মো. হারুন অর রশিদ; ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার মো. শমসের আলী, ত্রিশালের মো. শহিদুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জ সদরের নুরুল ইসলাম দিলীপ; পাবনার ঈশ্বরদীর মো. আক্তারুজ্জামান, মো. খায়রুল ইসলাম, মো. ইমান আলী, ছায়েদ আলী, মসলেম উদ্দিন, মো. আমিরুল ইসলাম, ডা. আ. কাদের আজাদ, মো. আতিয়ার রহমান, মো. গোলাম মহমুদ, মো. আতিয়ার রহমান, মো. নূর মোহাম্মদ, মো. মজিবর রহমান; শরীয়তপুরের গোসাইরহাটের মো. আলী আহম্মদ আকন, বগুড়ার শেরপুরের মজিবর রহমান, গোপালগঞ্জ সদরের বিএম আলী আহম্মদ, জামালপুরের বকশীগঞ্জের মো. দেলোয়ার হোসেন, মো. আবদুর রাজ্জাক; রাজশাহীর পবার মো. আফাজ উদ্দিন, মৃত আ. সাত্তার, মো. সামছুল হক; খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার চান মিয়া; কুমিল্লার লাকসামের মনিরুল আনোয়ার, আবুল কালাম আজাদ, আনা মিয়া, মো. শফিকুর রহমান; পাবনা সদরের মো. খালেকুজ্জামান, মো. আবদুল মজিদ, মো. ইজিবর রহমান, মো. রুহুল আমীন, মো. মকছুদুল হক ফিরোজ, মো. খলিলুর রহমান, মো. আবু বকর সিদ্দিক, মো. তোফাজ্জল হোসেন (হেলাল), মো. লুৎফর রহমান, মো. সাইদুর রহমান, মো. আ. রহমান, মো. আবদুল করিম, মো. মজিবর রহমান, এএসএম ইজহারুল ইসলাম, মো. আবদুল জব্বার খান, মীর্জা মো. ইদ্রিস আলী, মো. আ. রশিদ; সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের নুরুল আমিন ও আবুল হাসেম।