জহির রায়হান, বান্দরবান:
থানছির করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যবসায়ী তিনদিন ধরে বান্দরবান সদর হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডে অন্যান্য রোগীদের সাথে চিকিৎসা নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সাধারণ ওয়ার্ডে এই করোনা আক্রান্ত ব্যবসায়ী চিকিৎসাকালীন সময়ে অন্যান্য রোগী ও আত্মীয়-স্বজনদের সংস্পর্শে আসায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বান্দরবান পৌরশহর। এঘটনায় শহরে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশংকায় চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে পৌরবাসীর মধ্যে।
ডাক্তারদের অসর্তকতা ও অবেহেলার কারণে পুরো পৌর শহরকে ঝুঁকি ও মানুষকে আতংকের মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ তুললেও বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বান্দরবান সিভিল সার্জন ডাঃ অং সুই প্রু মারমা।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন অফিস মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টায় বান্দরবানের দুইজন পুরুষ ও এক নারী করোনা পজেটিভ পাওয়া গেছে বলে ঘোষনা দেন। এরপরে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ থানছি সোনালী ব্যাংকের এক পুলিশ গার্ড ও একজন ঠিকাদার এবং লামার মেরাখোলায় এক নারী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এদের মধ্যে পুলিশ সদস্যটি থানছি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন এবং ব্যবসায়ী সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এছাড়াও লামার নারীটি নিজ বাসায় কোয়ারেন্টাইনে রয়েছে।
এদিকে স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছেন, সদর হাসপাতালে চিকিৎসারত থানছির করোনা আক্রান্ত ব্যবসায়ীর সংস্পর্শে আসা ৭জন ডাক্তার ও ১০জন নার্সকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও উক্ত ব্যবসায়ী যে ওয়ার্ডে ছিল। সে ওয়ার্ডটি সম্পূর্ণ লকডাউন করে অন্যান্য রোগীদের কোয়ারেন্টাইনে গভীর পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
এদিকে করোনা আক্রান্ত থানছির ব্যবসায়ী সদর হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডে অন্যান্য রোগীদের সাথে তিনদিন ধরে চিকিৎসারত থাকার খবরে স্থানীয়দের মাঝে আতংক দেখা দিয়েছে। এঘটনায় অনেকে তরুণ-তরুণী, যুবক ও বয়বৃদ্ধসহ স্থানীয় জনসাধারণকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। অনেকে এঘটনাকে ডাক্তারদের দায়িত্ব অবহেলা হিসেবে দেখছে।
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও করোনা কর্মহীনদের মানবিক সহায়তাদানকারী স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন বান্দরবান-পরিবারের সমন্বয়ক তৌহিদুর রহমান রাশেদ চৌধুরী জানান, করোনা আক্রান্ত রোগীকে কিভাবে সাধারণ ওয়ার্ডে অন্যান্য রোগীদের সাথে তিনদিন যাবত চিকিৎসা দেয়া হলো?। তিনি বলেন, এখবর জানান পর থেকে আমিসহ আমার পরিবার আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। এঘটনায় বর্তমানে পুরো পৌরশহর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে তিনি মনে করেন।
অন্যান্য রোগীদের সাথে একই ওয়ার্ডে রেখে করোনা আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ায় এখন পৌরশহরের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশংকা করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয়রা। তারা বলেন, অন্যান্য রোগীদের সাথে থাকা ও তাদেরকে দেখতে আসা আত্মীয়-স্বজন, লোকজন বাড়ি গিয়ে পরিবারসহ কে কোথায় কার সাথে দেখা সাক্ষাত করেছে এবং কোথায় গেছে এর হিসাবে তো কেউ দিতে পারবে না। এরফলে পুরো পৌর শহরবাসী ঝুঁকি মধ্যে পড়ে গেছে বলে তাদের অভিযোগ। বিষয়টি খুবই দূঃখজনক বলে জানান স্থানীয় সচেতন মহল।
স্থানীয় সাংবাদিক উজ্জল তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, অন্যান্য রোগীদের সাথে একই ওয়ার্ডে রেখে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার খবর শোনার পর থেকে আমি ও আমার পরিবারের মধ্যে আতংক দেখা দিয়েছে। শুরু আমরা নয়, আমাদের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীসহ সকলেই মধ্যে করোনা আতংক ঝেঁকে বসেছে।
স্থানীয় সচেতন মহলের অনেকে জানান, ঐ তিনদিন করোনা আক্রান্তদের সাথে অন্য কতজন রোগী চিকিৎসাধীন ছিল। তা হাসপাতালের ভর্তির তালিকায় নাম-ঠিকানা রয়েছে। এমূহুর্তে তালিকা দেখে ঐসব রোগীকে দ্রুত খুঁজে বের করে কোয়ারেন্টাইনে রাখা জরুরী। এছাড়াও ঐসময় এসব রোগীদের সাথে থাকা ও দেখা করতে আসা আত্মীয়-স্বজন এবং লোকজনের খোঁজ খবর নিয়ে তাদেরকেও হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষে প্রতি দাবী জানিয়েছেন তারা। ঐসব সকলকে কোয়ারেন্টাইনে আওতায় আনা গেলে পৌর শহরের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকির আশংকা কমে যাবে এবং স্থানীয় আতংকগ্রস্তদের মাঝে স্বস্থি ফিরে আসবে বলে মনে করেন সচেতন মহল।
পার্বত্য জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, গত ০৯ এপ্রিল করোনা সংকট নিয়ে পরিষদে এক জরুরী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা হাসপাতালের কার্যক্রম তদারকির জন্য পরিষদ সদস্য লক্ষীপদ দাশ ও ক্য সা প্রুকে দায়িত্ব দেন।
করোনা আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে অন্য রোগীদের একই সাথে চিকিৎসা সেবা দেয়ার বিষয়ে বুধবার (২২এপ্রিল) দুপুরে সদর হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা পরিষদ সদস্য লক্ষীপদ দাশকে মুটোফোনে আলাপকালে প্রশ্ন করা হলে তিনি এপ্রতিবেদককে জানান, রোগীদের চিকিৎসা দেয়া বিষয়টি একান্তই হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তারদের বিষয়। আমরা দায়িত্বপ্রাপ্তরা হাসপাতাল ও ডাক্তারদের কোন সমস্যা হলে, তা সমাধানে এবং জরুরী কোন জিনিসপত্র প্রয়োজন হলে সেবিষয়ে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করছি মাত্র। তিনি আরো জানান, করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীদের যাতে বাড়িতে যেত না হয়, তারজন্য হোটেলের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও আসা-যাওয়ার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। তারা বাড়িতে গেলে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়াতে পারে সে আশংকায় জেলা পরিষদের এই পদক্ষেপ নিয়েছে। তিনি বলেন, ডাক্তারদের থাকা ও খাওয়ার জন্য হোটেল পর্যটন মোটেল, নার্সদের জন্য হোটেল নাইট হেভেন এবং কর্মচারীদের জন্য শহরের ৩নাম্বার এলাকায় নবনির্মিত হোটেল গার্ডেন সিটি বুকিং করে রাখা হয়েছে।
সদর হাসপাতাল ও জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, করোনা আক্রান্ত থানছি থেকে আসা ব্যবসায়ী তথ্য গোপন করে সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। সে প্রথমে থানছি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন ছিল। সেখানে সে তার করোনা হয়নি দাবী করে কর্তৃপক্ষকে নিজ দায়িত্বে (নিজ জিম্মানামায় স্বাক্ষর) করে চলে যায়। এরপর সে ব্যক্তি গোপনে বান্দরবান শহরের আসেন এবং সব তথ্য গোপন করে সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, থানছি করোনা আক্রান্ত ঐব্যবসায়ীর এক ছেলে ঢাকায় পড়াশোনা করেন। সে ছেলে কাছে আসা-যাওয়া করতেন। ঢাকা থেকে উক্ত ব্যবসায়ী করোনা আক্রান্ত হয়েছে। তবে ডাক্তারদের কাছে তিনি এখনো সকল তথ্য গোপন করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ স্বাস্থ্য বিভাগের। আর পুলিশ সদস্যটি বাড়ি বরিশাল, সে থানছিতে আসার আগে চট্টগ্রামের চকরিয়ার লোহাগাড়ায় চাকরী করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। সেখান থেকে সে করোনা সংক্রমিত হয়েছে বলে স্বাস্থ্য বিভাগের ধারনা। এছাড়াও লামা মেরাখোলা করোনা আক্রান্ত নারীটি বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ বহিরাগতদের কোন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি সংস্পর্শে যাওয়ায় তিনি সংক্রমিত হয়ে বলেও ধারণা করছে।
এব্যাপারে সিভিল সার্জন অং সুই প্রু মারমা এপ্রতিবেদককে জানান, উক্ত আক্রান্ত ব্যক্তি তথ্য গোপন করে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ডাক্তাররা তার নমুনা সংগ্রহ করতে চাইলে সে প্রথমে অনিহা প্রকাশ করেন। সিভিল সার্জন আরো জানান, ইতিমধ্যে সদর হাসপাতালের একটি অংশ লকডাউন করা হয়েছে। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা অন্যান্য রোগীদের কোয়ারেন্টাইনে রেখে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এছাড়াও রোগীদের সাথে থাকা এবং তাদের দেখতে আসার আত্মীয়-স্বজন ও লোকজনের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তাদেরকেও হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখার উদ্যোগে নেয়া হয়েছে বলে সিভিল সার্জন জানিয়েছেন।
এদিকে থানছি উপজেলায় করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যের সংস্পর্শে আসায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক এবং কয়েকজন পুলিশ সদস্যসহ মোট ৭জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে নেয়া হয়েছে। এছাড়াও থানছি উপজেলার সদর বাজার ও বলিপাড়া বাজার লকডাউন করা হয়েছে। দুপুরের থানা ভবন ও ব্যাংক লকডাউন করা হয়েছে বলে ইউএনও আরিফুল হক জানিয়েছেন।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, এ পর্যন্ত বান্দরবানে ১৯৫জন হোম কোয়ারেন্টাইনেও ১০জন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। এর আগে সীমান্ত উপজেলার নাইক্ষ্যংছড়িতে একজন করোনা রোগী শনাক্ত হয়। বর্তমানে মোট ৪জন ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হিসেবে সনাক্ত হয়েছে।