ঢাকা, শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১
বেসরকারি খাতে নেওয়ার উদ্যোগ

ঝুঁকিতে পড়বে পেট্রোলিয়ামসহ জ্বালানি নিরাপত্তা

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ২৪ জানুয়ারী ২০২৩ ০৮:৩৭:০০ অপরাহ্ন | অর্থনীতি ও বাণিজ্য

বেসরকারিভাবে জ্বালানিসহ অন্যান্য এনার্জি আমদানি ও বিপণনের সুযোগ তৈরি করতে যাচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে বেসরকারি পর্যায়ে জ্বালানি আমদানি, মজুত, বিতরণ, বিপণনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পদক্ষেপ নিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। পাশাপাশি নতুন করে নীতিমালা প্রণয়নের জন্য গঠন করা হয়েছে সাত সদস্যের কমিটি। পেট্রোলিয়াম তরল জ্বালানি বেসরকারি খাতে গেলে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

 

 

 

 

জানা যায়, গত বছরের ২৮ নভেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে বেসরকারি পর্যায়ে জ্বালানিসহ এনার্জি আমদানি ও বিপণনের সুযোগ তৈরির বিষয়ে আলোচনা হয়। সভা শেষে ওই সময়ের মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, জ্বালানিসহ অন্যান্য এনার্জি বেসরকারিভাবে আমদানির ব্যবস্থা করা যায় কি না, তা নিয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বেসরকারি আমদানিকারকরা আমদানি করে নিজেরাই খোলাবাজারে বিক্রি করবেন নাকি সরকারের কাছে বিক্রি করবেন সেটি আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

 

 

 

মন্ত্রিসভা কমিটিতে আলোচনার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীসময়ে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। কমিটিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (অপারেশন-১) আহ্বায়ক এবং উপ-সচিবকে (অপারেশন-১) সদস্য সচিব করা হয়।

 

 

গত ২৯ ডিসেম্বর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের উপ-সচিব (অপারেশন-১ শাখা) শেখ মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে বলা হয়, ‘বেসরকারি পর্যায়ে জ্বালানি তেল আমদানি, মজুত, বিতরণ, বিপণনের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং বিদ্যমান আইন, বিধি-বিধান ও পরিপত্রে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধন এবং সংযোজনসহ পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে এ সংক্রান্ত চর্চা পর্যালোচনাপূর্বক যুগোপযোগী এবং বাস্তবায়নযোগ্য একটি নীতিমালার খসড়া প্রণয়নের লক্ষ্যে নিম্নোক্তভাবে একটি কমিটি গঠন করা হলো। কমিটির সদস্যরা হলেন- জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের যুগ্ম-সচিব (অপারেশন-১), বিপিসির পরিচালক (বিপণন), মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন ও বাণিজ্য)।’ একই কমিটি প্রয়োজনে এক বা একাধিক সদস্যকে কো-অপ্ট করতে পারবে বলে অফিস আদেশে উল্লেখ করা হয়।

 

 

 

 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, ভোক্তা সংগঠনের নেতা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিনি, ভোজ্যতেল থেকে পেঁয়াজ, লবণ নিয়েও আমাদের দেশে সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকে। নানা সময়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সরকারকে চাপেও ফেলেন সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা। বেশ কয়েক বছর ধরে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) মাধ্যমে খোলাবাজারে ভোগ্যপণ্য বিক্রি করে আসছে। পাশাপাশি চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য ওএমএস চালু রেখেছে। তবে বৈশ্বিক যাই পরিস্থিতি থাকুক না কেন, বাংলাদেশে জ্বালানি তেল নিয়ে ভোক্তাদের কখনো মাথা ঘামাতে হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকার কখনো দাম বাড়িয়েছে, কখনো কমিয়েছে। কিন্তু কৃত্রিম সংকটের মতো বড় ঝুঁকিতে পড়তে হয়নি সরকারকে।

 

বর্তমানে পেট্রোলিয়াম জ্বালানি আমদানি, পরিশোধন, বিপণন ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। কিছু বেসরকারি পরিশোধন ইউনিটের মাধ্যমে কনডেনসেট পরিশোধন করে উৎপাদিত ডিজেল পেট্রোলও বিপিসি কিনে নিজেরা বিপণন কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে বাজারজাত করে আসছে। এর মধ্যে ডিজেল, অকটেন ও পেট্রলে মাঝে মধ্যে ভেজাল মিশ্রণের অভিযোগ উঠলেও বিপিসির নানান পদক্ষেপের কারণে তা নিয়ন্ত্রণে থাকে।

 

বিজ্ঞাপন

 

 

আরও পড়ুন>> বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এলপিজি বিক্রি করতে চায় বিপিসি, লাভবান কে?

 

বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে কমবেশি ৭০ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেলের চাহিদা থাকে। জ্বালানির ৮ শতাংশ স্থানীয় উৎস থেকে পাওয়া গেলেও ৯২ শতাংশ আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়। এর মধ্যে ১৫ লাখ মেট্রিক টন ক্রুড পরিশোধন করা হয়। অবশিষ্ট প্রায় ৫০ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করে বিপিসি।

 

 

 

 

 

বিপিসির তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৭০ দশমিক ১৫ শতাংশ ডিজেল, ৮ দশমিক ২৭ শতাংশ ফার্নেস অয়েল, ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ পেট্রল, ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ জেট এ-১, ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ অকটেন, ১ দশমিক ২৫ শতাংশ কেরোসিন রয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬৯ লাখ ১৫ হাজার টন জ্বালানি পণ্য বিক্রি করেছে বিপিসি। এর মধ্যে সরকারি উৎস হিসেবে সরকারি-বেসরকারি ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট থেকে পাওয়া গেছে ৪ লাখ ১১ হাজার ৭শ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭২ লাখ টন জ্বালানির চাহিদা দিয়েছে বিপিসি।

 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ফার্নেস অয়েল, লুব অয়েল, বিটুমিন, গ্রিজসহ নানান পেট্রোলিয়াম পণ্য বেসরকারি পর্যায়ে উৎপাদন ও আমদানি, বিতরণ ও বিপণনের সুযোগ রয়েছে। এগুলো বেসরকারি খাতে থাকলেও তেমন প্রভাব তৈরি হয় না। কিন্তু ডিজেল, পেট্রল, অকটেন, জেট ফুয়েল, মেরিন ফুয়েল (ফার্নেস অয়েল) আমদানি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে দেশে নতুন করে সংকট তৈরি হবে, যা ভোক্তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে জ্বালানি নিরাপত্তা আরও বেশি হুমকিতে পড়তে পারে বলেও মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

বর্তমানে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে (আইপিপি) ফার্নেস অয়েল আমদানির সুযোগ দিয়েছে সরকার। সেই সুযোগও সময়ে সময়ে নিজের মতো করে কাজে লাগায় আইপিপিগুলো।

 

 

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, সরকারি-বেসরকারি মিলে দেশে বর্তমানে ফার্নেস অয়েলনির্ভর ৫২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে মাসে ৬০ হাজার টন ফার্নেস অয়েলের চাহিদা রয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ফার্নেস অয়েল আমদানি শুরু করে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো (আইপিপি)। এরপর আইপিপিগুলোতে ফার্নেস অয়েল সরবরাহ বন্ধ করে বিপিসি। আইপিপিগুলোকে ফার্নেস অয়েল আমদানির সুযোগ দেওয়া হলেও শর্ত ছিল ১০-১২ শতাংশ ফার্নেস অয়েল বিপিসি থেকে নিতে হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কম থাকলে চুক্তির শর্ত মোতাবেক চাহিদার ১০-২০ শতাংশ জ্বালানি বিপিসি থেকে নেওয়ার কথা থাকলেও নিতেন না। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে আইপিপিগুলো সেই শর্ত কাজে লাগিয়ে বিপিসি থেকে ফার্নেস অয়েল নেওয়া শুরু করে।

 

ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় গঠিত কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, পেট্রোলিয়াম জ্বালানি বর্তমানে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। একটি বেসরকারি খাতে গেলে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বর্তমান যা দাম পড়ছে, বেসরকারি খাতে গেলে তাতে সরকারের তুলনায় ২০-৩০ শতাংশ দাম বেশি পড়বে। দাম বাড়লে ভোক্তারা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

 

‘সব জায়গায় বর্তমানে সিন্ডিকেট রয়েছে। বেসরকারি খাতে গেলে তা আরও বাড়বে। বেসরকারি খাতে তরল জ্বালানি আমদানি ও বিপণনের জন্য যাদের লাইসেন্স দেওয়া হবে, তাও প্রতিযোগিতামূলকভাবে দেওয়া হবে না। এখন যারা বেসরকারিভাবে পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানিতে জড়িত তারাই পাবে। এর মধ্যে এখন অনেক প্রতিষ্ঠান হয়েই আছে। একক কর্তৃত্ববাদী গোষ্ঠী কিংবা কোম্পানি যা করছে, এটাতেও তার ব্যতিক্রম হবে না।’

 

 

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিপিসি থেকে ফার্নেস অয়েল কেনেন ৭৪ টাকায়। সেখানে বেসরকারি খাত থেকে কেনেন ৯২ টাকায়। এক লিটারে বেশি দিতে হয় ১৮ টাকা। যেখানে পণ্যের মূল্য বেশি থাকে, সেখানে লাভও বেশি থাকে। সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্সও বেশি হয়। এগুলো সরাসরি অন্যান্য পণ্যের মূল্যকেও প্রভাবিত করে। এতে বাজারে পণ্যের মূল্য বাড়বে।

 

 

তিনি বলেন, আমরা জ্বালানি খাতকে বেসরকারিতে দেয়ার বিপক্ষে। এটা ভোক্তাস্বার্থ বিরোধী, জনস্বার্থের পরিপন্থি। জ্বালানিতে এখনো সংকট আছে, বেসরকারিখাতে গেলে এ সংকট আরও বাড়বে। আমদানি করা জ্বালানির ওপর পুরো দেশকে নির্ভর করতে হচ্ছে। এটিকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার মতো ভয়াবহ আর কিছু হতে পারে না।

 

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, বিশ্বের প্রতিটি দেশে জ্বালানি খাতকে সরকারি খাত হিসেবে রাখা হয়। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতেও বিশেষ করে আমেরিকা, ব্রিটেনে জনগুরুত্বপূর্ণ কমোডিটির যে শিল্পগুলো আছে, বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য খাতগুলোকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রাখা হয়।

 

তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, আমাদের দেশে যখন স্টিল মিল সরকারি ছিল, ব্যবসায়ীরা যা খুশি তা করতে পারেননি। সিন্ডিকেট কারসাজির মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে শ্রমিকদের ওপর দোষ চাপিয়ে সরকারি স্টিল মিলকে ধ্বংস করা হয়েছে। রুবি সিমেন্টের মতো একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারিতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

 

‘যে সমস্ত খাত থেকে সরকার হাত গুটিয়ে নিয়েছে, সেখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। এখন চিনির বাজার ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে জ্বালানি খাত। এই জ্বালানি প্রাইভেট সেক্টরকে দেওয়া হলে বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’

 

বেসরকারি খাতে পেট্রোলিয়াম জ্বালানি আমদানি ও বিপণন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ অনেক দেশে রয়েছে। তবে তা সীমিত এবং তাতে সরকারি তদারকি কঠোর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের দেশে চাল নিয়ে কারসাজি হয়। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা কারসাজি করেন। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে কম দামে খোলা বাজারে চাল বিক্রি করতে হয়। একইভাবে টিসিবির মাধ্যমে ট্রাকে করে রাস্তায় রাস্তায় ভোগ্যপণ্য বিক্রি করতে হয়। জ্বালানিকে বিশেষ করে ডিজেল, পেট্রল, অকটেন আমদানি ও বিপণনের সুযোগ বেসরকারি পর্যায়ে দেওয়া হলে, অদূর ভবিষ্যতে বাজার নিয়ন্ত্রণে হয়তো বিপিসিকেও ড্রাম দিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে তেল বিক্রি করতে হবে।

 

এদিকে কমিটি গঠনের প্রায় তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনো প্রথম বৈঠকে বসতে পারেনি গঠিত কমিটি। কমিটির সদস্য বিপিসির পরিচালন (বিপণন) অনুপম বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, এখনো কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। একবার মিটিং ডাকা হয়েছিল, কিন্তু পরে বাতিল করা হয়।’