- দপ্তরের কয়েক কর্মকর্তার ম্যানেজ হওয়া
- প্রয়োজনীয় লোকবলের সংকট
- আইন প্রক্রিয়ায় বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা
- ইটিপি প্লান্ট কার্যকরে নেই নজরদারী
- চাষের জমি ও পাহাড় নিধনে চলছে ইটভাটা
পাহাড়, সমুদ্র, উপত্যকা, বন-বনানীর কারণে চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম লীলাভূমি হিসাবে পরিচিত। সেই পরিচিতি যেন দিনের পর দিন হারিয়ে যাচ্ছে। পাহাড় খেকোরা পাহাড় কেটে পাহাড়ের অস্তিত্ব ধবংস করছে। নগর ও জেলার অনেক নদী ও পুকুর ভরাট হয়ে হারিয়েছে তার অস্তিত্ব। কাটা হচ্ছে সীতাকুন্ড, ভাটিয়ারী, মানিকছড়ি, চকরিয়া, বাশখালী, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবানের বনবনানী। ম্লান হচ্ছে চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। সেই সাথে মিল ফ্যাক্টরীর বজ্য ও রাসায়নিকে ইটিপি প্লান্টের প্রয়োগের কথা থাকলেও মানছেনা অনেক মিল ফ্যাক্টরী, গড়ে উঠা অনেক ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কয়লার পরিবর্তে টায়ার ও গাছ। ফ্যাক্টরীর রাসায়নিক ও মেডিকেল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে যত্রতত্র। সেইসাথে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোর শতভাগ হয়নি এখনো গ্রিন শিপ ইয়ার্ড। এসব ইয়ার্ডগুলোর বজ্য পড়ছে সাগরে। নষ্ট হচ্ছে পানি ও মাছের প্রজনন। ভোক্তভোগীরা বলেন, পরিবেশ দপ্তরের সঠিক নজড়দারীর অভাবে হারাচ্ছে মানবীয় পরিবেশের ভারসাম্য এবং দিনের পর দিন উষ্ণ নগরীতে পরিণত হচ্ছে চট্টগ্রাম। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিগত বছর গুলোতে কয়েক হাজার পুকুর দিঘী ও জলাশয় ভরাট হয়েছে চট্টগ্রামে। এর মধ্যে রয়েছে অনেক ঐতিহ্যবাহী পুকুর-জলাশয়। চট্টগ্রামের অনেক এলাকায় এখন আর পুকুর নেই। হয়তো বর্তমান প্রজন্ম সামনের সময়ে জাদুঘরে পুকুরের আকৃতি দেখতে যাবে। জানা যায়, চট্টগ্রামে অনেক পুকুরের নামে এলাকার নাম আছে কিন্ত পুকুর নেই। দেওয়ানজী পুকুর লেন, আন্দরকিল্লার ‘রাজা পুকুর লেন’ নাম ঠিক থাকলেও নেই আজ পুকুর। বলুয়ার দিঘিও এখন শুধু নাম বহন করছে। চট্টগ্রামের আরেক ঐতিহ্যবাহী আশকার দিঘিও দখলে জর্জরিত। দিঘির চারদিকে উঠেছে বহুতল স্থাপনা। দখল-দূষণে সংকুচিত হচ্ছে এনায়েত বাজার এলাকার রানির দিঘি, পাহাড়তলীর পদ্মপুকুর, বড় মিয়ার মসজিদ পুকুর, হালিশহরের খাজা দিঘি, চান্দগাঁওয়ের মুন্সি পুকুর, বাকলিয়ার আবদুল্লাহ সওদাগর পুকুর, আগ্রাবাদ ঢেবা, আগ্রাবাদের দাম্মো দিঘি, কর্নেল হাট দিঘি, হাজারীর দিঘি, কারবালা পুকুর, ভেলুয়ার দিঘি, কাজীর দিঘি ও রামপুর বড় পুকুর। পরিবেশ অধিদপ্তর মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে জরিমানা কিংবা মামলা করে দায় সেরেছে। অসংখ্য মামলা বিচারের অপেক্ষায়। এই ফাকে পরিবেশ ধ্বংস কারী ও পাহাড় খেকো, পুকুর খেকোরা ধ্বংস করে ফেলছে একের পর এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের জানালেও তারা একশন রিয়েকশনে যেতে যেতে রাতের আধারে বা ক্ষমতার দাপটে দিন দুপুরেই সাবাড় করে দিচ্ছে জাতীয় সম্পদগুলো।
সরেজমিনে দেখা যায়, এখনো চট্টগ্রামের প্রায় এলাকার পাহাড় যেমন আকবর শাহ, লালখান বাজার মতিঝর্না এলাকা, খুলশী, ফয়েজলেক, ছিন্নমুল, আলী নগর, নবীনগরসহ এলাকায় অবস্থিত অনেকগুলো পাহাড় কেটে সাবাড় করেছে পাহাড় খেকোরা। ভুমিদস্যুরা নির্মান করেছে প্লট, ব্যবসা করছে হাজার কোটি টাকা। সেই সাথে বর্তমানে বিদ্যমান থাকা নগরে ঐতিহ্যবাহী অনেক পুকুর এখন ধ্বংসের মুখে। ভরাট হয়ে যাচ্ছে পুকুরগুলো। চট্টগ্রামে হাটহাজারী, বায়েজীদে গণপূর্তের শেরশা দিঘী, উত্তর চান্দগায়ের অনেকগুলো দিঘী, সদরঘাট এলাকায় কয়েকটা দিঘী এখন ভরাটের কবলে। ঐতিহ্যবাহী দিঘীগুলো ভরাট করে তৈরী করা হচ্ছে প্লট। সেইসাথে নদীর দুপাশে বসতি গড়ে সংকুচিত হওয়ায় নদীর শাখাগুলোতে পানির প্রবাহমানতায় বাধাগ্রস্থ ও হারিয়ে যাচ্ছে। সিটিকর্পোরেশন ও সিডিএ উদ্ধার অভিযান করলেও এখনো সিংহভাগ নদীর অংশ রয়েছে কিছু অসাধু মানুষের দখলে। যার কারনে নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। বর্ষাকালে নগরে চলে জলাবদ্ধতা।
নগরের কয়েকজন বলেন, সমাজের সজ্জন মানুষেরা অসাধু প্রভাবশালীদের ভয়ে মুখ খুলতে পারছেনা। মুখ খুললেও অনেক বিপদে পড়ার আশংকা রয়ে যায়। রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও প্রভাব রয়েছে তাদের সাথে। তাই নিজেরা বাধা না দিয়ে অনেকে গোপনে পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানায়। পরিবেশ অধিদপ্তর জানলেও তাদের তদন্ত, মামলা, শুনানী ও মামলা আদালতে যাওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ যে দীর্ঘসুত্রিতা হয় সেই দীর্ঘসুত্রিতার ফাকে সাবাড় হয়ে যায় নগরের মুল্যবান সম্পদ।
জানা যায়, স্বল্প জরিমানায় কোন তোয়াক্কা করছেনা পুকুর ভরাট কারী ও পাহাড় খেকোরা। তারা দিনের পর দিন আরো বেপোরোয়া হয়ে এসব ভরাট করছে। পাহাড়কে বলা হয় প্রকৃতির ভারসাম্য ও জমিনের পেরেক। কোন বাধাকেই বাধা মনে করছেনা ও শুনছেনা পাহাড় খেকোরা। তারা অসহায় গরিব লোকের পরিবার বসানোর নাম দিয়ে রাতের আধারে স্কেভেটর দিয়ে কেটে ফেলছে পাহাড়। তৈরী করছে নতুন এলাকা। সেই এলাকায় গরিব মানুষ বসিয়ে ভোটার দেখিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। সহযোগীতা নিতে চান তাদের। পরিবেশ নষ্ট হলে বা প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হলে কিছু যায় আসেনা এসব সরকারী ভুমি খাদকদের।
পরিবেশ দপ্তরের এক কর্মকর্তা সুত্রে জানা যায়, পাহাড় কাটা, পুকুর ভরাটসহ পরিবেশের এ ধরনের মামলাগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধ্বংসকারী ও ভরাটকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দেন না। যারা মামলা করেন, তারা পরবর্তীসময়ে সমঝোতা করে ফেলেন। শুধু তাই নয়, যারা পুকুর ভরাট করেন কিংবা পাহাড় কাটেন, যারা পরিবেশ দূষণ করেন তারা অনেকেই থাকে ধরাছোয়ার বাইরে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভূমিদস্যুরাই পুকুর ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মানুষ কৌশলে পুকুরের শ্রেণি পরিবর্তন করছে। এক্ষেত্রে খতিয়ানে জমির শ্রেণির পুকুর লেখা না থাকলে প্রতিকার পাওয়া দুষ্কর। পরিবেশ দপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, শ্রেনীতে পুকুর, জলাশয় না থাকলে আমাদের কিছু করার থাকেনা।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগর সহকারী পরিচালক রুবাইয়াত তাহরীম সৌরভ বলেন, আসলে এই দীর্ঘসুত্রিতায় পাহাড়, পুকুর খেকোরা এইসব প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করছে। আমরা চেষ্টা করছি এই দীর্ঘসত্রিতা কমাতে। তবে মামলা আদালতে গেলে আমাদের হাতে কিছু থাকেনা।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়ের উপ পরিচালক মোঃ ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, দীর্ঘসুত্রিতা আমাদের ইচ্ছাকৃত নয়। আমরা পাহাড় কাটা বা পুকুর ভরাট ও ইটভাটার বিষয়ে জানতে পারলে আমাদের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করি। অনেক সময় রাতে পাহাড় বা পুকুর ভরাট করার খবর পেলে সাথে সাথে আমাদের টিম পাঠাতে পারিনা। আমাদের লোকবল সংকট রয়েছে। মামলা চালাতেও অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘসুত্রিতা হয়। তবে আমরা চেষ্টা করছি বিষয়গুলো তদারকি করতে।
এ বিষয়ে জানতে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক হিল্লোল বিশ^াসকে মুঠোফোনে ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।