ঢাকা, শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

পার্বত্যাঞ্চলে অন্তর্ভূক্তিমূলক মানসম্মত বৈষম্যহীন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের অন্তরায় সমূহ

মো. কামরুল হাছান | প্রকাশের সময় : বুধবার ৬ নভেম্বর ২০২৪ ০৭:৪৮:০০ অপরাহ্ন | মতামত

শিশুরা জন্মগতভাবেই অধিকার রাখে শিক্ষার ও নিরাপদে বেড়ে ওঠার। আন্তর্জাতিক এই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছেন আমাদের রাষ্ট্র প্রধান ও আমরাও ঐক্যমত্য পোষণ করি। শিশুদের জন্য আমাদের সকল আয়োজন। কিন্তু পার্বত্যাঞ্চলের সাথে রয়েছে সমতলের ভৌগলিক কিছু পার্থক্য তাই বাকী ৬১ জেলার যে চাহিদা বা আয়োজন তা অনেক ক্ষেত্রে এখানে সম্ভবপর হয়না।

যেমন ধরুণ ভবন নির্মাণ পাহাড়ের এমন কিছু বিদ্যালয় ভৌগলিক ও অবস্থানগত কারনে এতটা দুর্গম যে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সেখানে এই বাজেটে ভবনের কাজ কখনই করতে পারবেনা। তাহলে কি সেখানে ভবন নির্মাণ হবেনা! হবে তখনই যখন সেখানে বিশেষ সহযোগিতা বা অতিরিক্ত বরাদ্দ পাবে। 

শিশুরা বিদ্যালয়ে আসে পাহাড় ডিঙিয়ে পায়ে হেঁটে, ছড়া, খাল বা নদী পেড়িয়ে কিংবা পাহাড়ী রাস্তা পার হয়ে। হ্রদবেষ্টিত এমন কিছু বিদ্যালয় আছে যেখানে শিশুরা আসে নৌকা বেয়ে। সেই সকাল ৮:৩০ বা ৯:০০ আগেই বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়। ১ম ও ২য় শ্রেনির ক্লাস শেষ ১২:০০ ও প্রাক-প্রাথমিক ১২:৩০টা। শিশুদের কোন কোন ক্ষেত্রে অভিভাবক এগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আবার তাদের নিতে আসবে ছুটির সময়ে কিংবা শিশুরা একাই যাবে তুলনামূলক বড় শিশুদের সাথে; অপেক্ষা করতে হয় বিকাল ৪:১৫ পর্যন্ত। শিক্ষক সংখ্যা ও কক্ষসংখ্যা সীমিত হওয়ার দরুণ প্রাক-প্রাথমিক, ১ম ও ২য় শ্রেণির শিশুদের জন্য ৩য়-৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের আগে এসে অপেক্ষা করতে হয়। যাদের আগে ছুটি হচ্ছে তাদের বয়স ৫-৭ বছর, তাদের বড়দের ছাড়া বাসায় যাওয়া অসম্ভব। তাদের ব্যাগে থাকেনা তেমন কোন খাবার, বিশুদ্ধ পানি, হয়তো সকালে সবাই খেয়েও আসেনি।

হয়তো রাতের খাবারের অবশিষ্ট কিছু খাবার নিয়ে এসেছে ছুটির পরে খাবে আবার ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির শিশুদের জন্যও একই অবস্থা। নিয়মিত অনাহার বা এমন খাদ্যগ্রহণ শিশুদের শারিরিক বৃদ্ধিতে বাঁধা হচ্ছে অন্যদিকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। প্রয়োজন দুপুরের খাবার বা বিকল্প সমাধান। এক্ষেত্রে পাহাড় কিছুটা ভিন্ন চাহিদার দাবি রাখে কারণ সমতলের শিশুদের ছুটির সাথে সাথেই বাসায় নিয়ে যাবার সুযোগ আছে। পাহাড়ে শিশুদের ছুটি হলেও তারা বড়দের ছুটির পর যেতে হয়।

বিদ্যালয় ভবন, ওয়াশব্লোক, নুন্যতম খেলার মাঠ, সৌরবিদ্যুৎ ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম এখন সময়ের দাবি। বিদ্যালয় এমন একটি আকর্ষণীয় প্রতিষ্ঠান হওয়া উচিৎ যেখানে এলে শিশু যাতায়াতের কষ্ট, পারিবারিক অভাব-অনটন, ভয় সকল কিছু ভুলে শিক্ষণ-শিখনের এক জগতে প্রবেশ করবে। শিক্ষক শুধুমাত্র ফ্লো ধরে রাখবে ও শিখনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেবেন; শিশু নিজ গুণে শিখবে। শিশু মনোবিজ্ঞানে এ ধারণাগুলো স্পষ্টত তাই বলে। শিক্ষার প্রধান নিয়ামকগুলো- শিক্ষাক্রম, শিশু, প্রতিষ্ঠান, পরিবেশ ও শিক্ষক এর কোন একটির করণে পুরো আয়োজন ব্যাহত হতে পারে।  

শিক্ষক প্রসঙ্গ- উপজেলার অভ্যন্তরে বদলী হলেও পার্বত্য ও দূর্গম হওয়াতে এমন স্কুল রয়েছে যেখানে পৌঁছাতে ১৮-২০ ঘন্টা সময় লাগে। সীমান্তবর্তী এই পার্বত্য এলাকায় নৌপথে ও পয়ে হেঁটে যোগাযোগ। এলাকাভেদে কয়েকমাস নৌপথে যাতায়াত করা যায়। নেই রাস্তা, নেই যানবাহন, তাই অনগ্রসর রয়েগেছে এ অঞ্চলের বহুসংখ্যক শিশু। শিক্ষার আওতায় রাখতে বাংলাদেশ সরকারের রয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়গুলোতে কাজ করে শিক্ষক। সকল দূর্গমতা ছাপিয়ে কাজ করেন সেখানে অবস্থান করে। জীবন যেখানে যেমন কথাটির গুরুত্ব ও নিজের কাজের ক্ষেত্র বিবেচনায় অর্পিত দায়িত্ব যতটা সম্ভব বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

আমাদের সাধারণ চিন্তায় রয়েছে যে একজন শিক্ষক নিজ উপজেলায় নিজ ইউনিয়নে চাকুরী করেন। পাহাড়ের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। নেই রাস্তাঘাট, যানবাহন, বিদ্যুৎ, মোবাইল নেটওয়ার্ক। একজন শিক্ষক পরিবার-পরিজন ছেড়ে বিদ্যালয় এলাকাতে অবস্থান করে দায়িত্ব পালন করতে যান। এমন কিছু বিদ্যালয় আছে যে আসা-যাওয়া করা যায় সপ্তাহে ২ দিন। সীমান্ত এলকা হিসেবে রয়েছে বিধি-নিষেধ। গতানুগতিক শিক্ষাক্রম ও আয়োজন এখানে থমকে যায়। শিশুদের জন্য সামান্য কিছু চিন্তা ও কাজের উদ্যোগ হতেপারে শিক্ষাউন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ২ কিলোমিটারের মধ্যে বিদ্যালয় স্থাপনের কথা রয়েছে কিন্তু পাহাড়ে এই ২ কিলোমিটার সমতলের ৫ কিলোমিটারের চাইতেও বেশি কষ্টকর। 

সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে হলে মা-বাবাকে বিদ্যালয়ে নিয়ে যেতে হয়। এমতাবস্থায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠির এই পরিবারের জন্য যা অসাধ্য প্রায়। যার ফলে নিয়মিত উপস্থিতি থাকে না এবং ব্যাহত হয় শিক্ষা কার্যক্রম। এছাড়াও বর্ষাকাল ও জুমের ফসল উত্তোলনের সময় রয়েছে আরো বড় ও দীর্ঘ অনুপস্থিতির সম্ভাবনা। বর্ষায় শিশুরা নয় শুধু বড়দের যাতায়াতের পথ ডুবে যাওয়া, ঝর্ণা বা নদীর স্রোতে কিংবা বিভিন্ন কারণে অনুপযোগী হয়ে যায়। সেখানে শিশুদের আসা যাওয়া শংকার। আর জুমের ধান তোলার সময় মা-বাবা বাড়ির বাইরে জুমেই শোষ্য সংগ্রহে ব্যাস্ত তাই শিশুদের তারা সাথে নিয়েই থাকতে চায়। তাদের বাৎসরিক খাবার সংগ্রহের এটাই মূল্যবান কাজের সময়। এ সময়ে তাদের বিদ্যালয়ে রাখতে হলে বিদ্যালয়েই শিশুদের অবস্থানের বিকল্প নেই। 

তুলনামূলক যোগাযোগ ব্যাবস্থা ভালো বিদ্যালয়গুলোতে (৮৩টির মধ্যে প্রায় ৬০টি) করা হয়েছে ওয়াশব্লোক আমার উপজেলায় মাত্র ০৪টি বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে কিন্তু ওয়াশব্লোকের সাথে করা হয়েছে এসি সাবমার্সিবল পাম্প। বিদ্যুৎ না থাকাতে পাম্প সম্পূর্ণ অচল ও পানির ব্যাবস্থা না থাকায় ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে আছে ওয়াশব্লোক। এমন সমস্যা গবেষণা ভিত্তিক আমার ক্ষুদ্র চিন্তা ও সুপারিশ পেশ করছি-

বাছাইকরা কিছু বিদ্যালয়ে আবাসিক শিক্ষার ব্যাবস্থা করা।

প্রত্যন্ত এলাকার বিদ্যালয় ভবনে শিক্ষকদের আবাসনের ব্যাবস্থা করা।

বিদ্যালয় সমূহে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে বিকল্প বিদ্যুতের ব্যাবস্থা করা।

মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা।

পানির ব্যাবস্থা সহ ওয়াশব্লোক ও বিশুদ্ধ পানির ব্যাবস্থা করা।

শিশুদের দুপুরের খাবারের ব্যাবস্থা করা।

শিক্ষক সল্পতা দূরীকরণ ও নিয়গের ক্ষেত্রে অবস্থান করে কাজের মানসিকতা যাচাই করেই নিয়োগ।

ওয়াইফাই নেটওয়ার্কেও আওতাভ‚ক্ত করা।

নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত মাতৃভাষায় পাঠদানের ব্যাবস্থা।

প্রতিটি শিশু মহামূল্যমান আমাদের জন্য। একটি শিশুও যদি শিক্ষা বঞ্চিত হয় ব্যাহত হবে আমাদের শিক্ষার আয়োজন ও অঙ্গীকার। শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার, ইউনিসেফ ও বিভিন্ন সংস্থা। তিন পার্বত্য জেলার অল্পকিছু সংখ্যক (অনধিক ৬০টি) বিদ্যালয়ে এই বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হলে এই সুবিধা বঞ্চিত কিছু শিশুর জন্য হতে পারে নিয়মিত ও প্রাথমিক শিক্ষার প্রকৃত শিক্ষা লাভের যুযোগ। বাড়বে উপস্থিতি বাড়বে অংশগ্রহণ। যে আলোয় আলোকিত হবে তার পরবর্তি শিক্ষা জীবন। দেশের প্রত্যান্ত এলাকা আলোকিত হলে আলোক উজ্জ্বল হবে পুরো মানচিত্র।

লেখক: মো. কামরুল হাছান

সহকারী শিক্ষক, দক্ষিণ বরুনাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

বরকল, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা