সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে সংঘবদ্ধ হয়ে পুরনো রূপে আধিপত্য বজায় রাখা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে শহীদ রফিক জব্বার হলের কতিপয় ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগের গুপ্তচর ও 'বি' টিম হিসেবে তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
অভিযুক্তরা হলেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের ৪৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার রশিদ রুম্মান, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ ৪৮ ব্যাচের মহসিউল তন্ময়, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ ৪৮ ব্যাচের রবিউল করিম সাগর, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ৪৮ ব্যাচের তানভীর হোসেন, নৃবিজ্ঞান বিভাগ ৪৮ ব্যাচের সৌমেন সৌম্য ও নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের ৪৮ ব্যাচের নিয়ামুল ইসলাম লিয়ন।
এদের কর্মকান্ডে বাংলা ৪৮ ব্যাচের তোহিদ তন্ময়, আইন ও বিচার বিভাগের ৪৯ ব্যাচের নিশাত সহ আরো কয়েকজন জুনিয়র ছাত্রলীগ কর্মীরাও যুক্ত রয়েছেন।
তাদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগে থাকাকালীন বিভিন্ন অপকর্মের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর ও হল ছাড়া করানো, হল সংলগ্ন দোকান ভাংচুর, চাঁদাবাজি, মাদক সেবন ও মাদকের যোগানদাতা হিসেবে সুপরিচিত ছিলো তাদের অনেকেই।
অভিযোগ উঠেছে হলে ছাত্রলীগের কার্যক্রম থেমে গেলেও ছাত্রলীগের এসব কর্মীরা পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়ে হলের সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর অধিপত্য বিরাজ ও হলের নিয়ন্ত্রণ নিতে নানা প্রচেষ্টা শুরু করেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ঘাপটি মেরে থেকে সুযোগ বুঝে খোলস পাল্টিয়ে প্রকাশ্যে এসে ব্যাচের বলয় সৃষ্টি করে আধিপত্য ধরে রাখার পায়তারা করছে।
ইতিমধ্যে তারা নিজেদের সংগঠিত করে জুনিয়রদের উপর প্রভাব বিস্তার, হলের সিনিয়র শিক্ষার্থীদের সাথে বেয়াদবি ও হুমকী প্রদান, কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে দূর্বব্যবহার, হলের ৩৩৪ নং রুম সহ কয়েকটি রুমে গাজা ও মাদকের আসর বসানো, ব্লকের রুম দখলসহ নানা অপকর্ম শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
এছাড়াও, সম্প্রতি গত ১৬ জুলাই রাতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের তালিকা করতে গিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত আক্রোশে অনেক নিরপরাধ ছাত্রদের নাম যুক্ত করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। উদ্দেশ্যমূলক ভাবে তালিকায় কয়েকজনের নাম যুক্ত করে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়ায় তাদের পক্ষে সাফাই গাইতে জুনিয়রদের নির্দেশনা দিয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার হল প্রশাসন কর্তৃক রাজনৈতিক ব্লক সিলগালা করা হলে অভিযুক্তদের কয়েকজন জোর পূর্বক সিলগালা ভেঙ্গে রুম দখল করে।
অভিযুক্ত শাহরিয়ার রশিদ রুম্মান ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। হলে নিয়মিত মাদক সেবন ও ৪৪ ব্যাচের এক নেতার ছত্রছায়ায় রুমে মাদকের আসর বসাতেন তিনি। মহসিউল তন্ময় ছাত্রলীগের উগ্র কর্মী হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। হলের সামনে এক অসহায় মহিলার পিঠার দোকান ভাঙচুর করায় সিনিয়রদের সাথে দ্বন্দ্বে কয়েকমাস আগে ব্লক ছেড়েছিল।
রবিউল করিম সাগর ছাত্রলীগে থাকা কালীন উগ্র আচরণ ও সিনিয়র জুনিয়রদের সাথে দূর্বব্যবহার করতেন। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে পারিবারিক রাজনৈতিক পরিচয় লুকিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি করা, স্বার্থ আদায়ে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করা সহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। তানভীর হোসেন হল ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। নানা সময় হলের আশেপাশে বিভিন্ন সমস্যার অন্যতম হোতা ছিলেন এই ছাত্রলীগ কর্মী। নিয়মিত গাজা সেবন ও গাজার আসরে নেতৃত্ব দেন।
নিয়ামুল ইসলাম লিয়ন হলে ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় নানা উগ্র কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। কিছুদিন পূ্র্বে শহীদ রফিক জব্বার হলের পাশের খাবার দোকানে এক ছাত্রীকে মারধরের অভিযোগ প্রক্টর অফিসে জমা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নিজেই হলের অবৈধ শিক্ষার্থী হলেও সেটা গোপন করে অন্য শিক্ষার্থীদের হল ছাড়া করার হুমকী দেন। সৌমেন সৌম্য ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে বিভিন্ন উগ্র কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করেছেন। নিয়মিত মাদক সেবন ও বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীদের এনে মাদকের আসর বসায় তার রুমে।
হলের শিক্ষার্থীরা জানান, ছাত্রলীগ হিসেবে নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে না পারলেও সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে অভিযুক্তরা সংঘবদ্ধ হয়ে পুরনো রূপে ফিরে আসার চেষ্টা করছেন। হামলায় জড়িত না থাকা ছাত্রলীগ কর্মীদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মত করে হলে অবস্থান করতে বলা হলেও তারা সবার উপর অধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা। এ নিয়ে হলে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিস সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্তরা সবাই হলের অবৈধ শিক্ষার্থী। তাদের সবাই অন্য হলে এলোটেড। তবে নির্দিষ্ট সিনিয়রের সাথে রাজনীতি করতে তারা সবাই রফিক জব্বার হলের অবস্হান করেছিলেন।
নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী এসব ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্হা গ্রহনের দাবি জানিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত শাহরিয়ার রশিদ রুম্মান বলেন, আমি এক সময় ছাত্রলীগ করতাম কিন্তু পরে ছাত্রলীগ থেকে বের হয়ে আসি। তবে হলের ছাত্রলীগের কয়েকজনের সাথে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। ছাত্রলীগ কোনো ভাবে আমার মাধ্যমে হলে আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে না
নিজের রুমে মাদকের আসর বসানোর বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের রুমে কখনো মাদকের আসর বসেনি। তবে আমার রুমে বন্ধুরা আসতো, আড্ডা দিত, আমরা একসাথে তাস খেলতাম।
মহসিউল তন্ময় বলেন, আমি আগে ছাত্রলীগ করতাম কিন্তু পরে ব্লক ছেড়েছিলাম। শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ঘটনার পর আমরা আন্দোলন করেছি। আজ যদি ছাত্রলীগ হলে থাকতো, তাহলে সবার আগে আমরাই হল থেকে তাদেরকে বের করে দিতাম। আর মাদকের সাথে কখনোই আমার সম্পর্ক ছিল না। হলের ৩৩৪নং রুমে আমরা বন্ধুরা মিলে শুধু আড্ডাই দিতাম।
হল ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা জানান, অভিযুক্ত সবাই আমাদের সাথে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতো। তাদের অনেকের আচরণ খুবই উগ্র ছিলো। প্রায় সময়ই নানা অপকর্ম করতেন। এসব সমাধান করতে গিয়ে সিনিয়রদের ভোগান্তি পোহাতে হতো। একজন নেতার অনুসারী হিসেবে এদের কয়েকজন হলে মাদকের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। এসব নিয়ে আমাদের সাথে তাদের অনেকবার মতবিরোধ হয়েছে। বর্তমানে তাদের কোন কর্মকান্ড আমাদের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। এসব তাদের ব্যক্তিগত বিষয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার সমন্বয়ক আহসান লাবিব বলেন, যারা নামে বেনামে ছাত্রলীগকে হলে উঠানো চেষ্টা করছে, রুম ভাংচুর করছে, মাদক সিন্ডিকেট পরিচালনা করছে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
শহীদ রফিক জব্বার হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. শাহেদ রানা বলেন, আমি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করেছি। তবে হলে এখনো কে বা কারা ছাত্রলীগ করে এটা নিয়ে কোনো কথা হয়নি। হলের উদ্ধারকৃত রুমগুলো তালা মেরে রেখেছি এবং হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে রুম শিক্ষার্থীদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হবে। তবে কেউ যদি রুমগুলার তালা ভাঙে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হবে। হলে মাদকের বিষয়ে আমি আগেও সচেষ্ট ছিলাম। এখন আবারো মাদকের বিরুদ্ধে আমি কঠোর ব্যবস্হা গ্রহন করবো।