চট্টগ্রামের হাটহাজারি থানাধীন ভবানীপুর সংলগ্ন আওলার দিঘির পাড় এলাকার কবরস্থান থেকে বিষ খাওয়া অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল নিয়ে গেলে তার একদিন পর গত ৫ডিসেম্বর মারা যায় বৃদ্ধ সোলাইমান(৭৫)। কবরস্থানের পাশে ধান ক্ষেতের বিলের মাঝে বৃদ্ধ বয়সে সোলায়মান বিষ খেয়েছে না খাওয়ানো হয়েছে এ নিয়ে নানা গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছে হাটহাজারী এলাকাবাসীর মাঝে ।
জানা যায়, এই ৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধকে গত ৪ই ডিসেম্বর রাত নয়টায় বিষ খাওয়া অবস্থায় কবর পাড় থেকে উদ্ধার করে তার মেঝ মেয়ের জামাই সাহাবুদ্ধিন প্রকাশ সাহাবু। শশুরকে ভবানীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে নিজ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে চার ঘন্টা তার গায়ের ময়লা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাত আনুমানিক ২টা থেকে ৩টার দিকে হাটহাজারী হাসপাতালে নিয়ে যান। কর্তব্যরত ডাক্তার অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে মৃত সোলেমানকে দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করার নির্দেশ দেন। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নিয়ে গেলে সে পরেরদিন ভোর ছয়টায় মৃত্যু বরন করেন। বৃদ্ধ সোলায়মানের নিরব মৃত্যুর পর এলাকায় গুঞ্জন উঠে সোলায়মান কি বিষ খেয়েছে নাকি বিলের মাঝে জোড় পূর্বক বিষ খাওয়ানো হয়েছে? কবরপাড়ে মেয়ের জামাই সাহাবু তার নিজ শ^শুড়কে বিষ খাওয়া অবস্থায় দেখে নিকটবর্তী হাটহাজারী থানাকে অবহিত না করে বা অন্যান্য আত্নীয় স্বজন বা প্রতিবেশীদের না জানিয়ে নিজেই সব কাজ সমাধান করলেন কেন?
পারিবারিক সুত্রে জানা যায়, বছর দুয়েক আগেও বৃদ্ধ সোলায়মান পেশায় একজন বাস চালক ছিলেন। তিনি হাটহাজারীর ফতেহপুর ৯নং ওয়ার্ডের মোবারক আলীর বাড়ির মরহুম ছালেহ আহম্মেদের ছেলে। নিজের পেশা নিয়ে এলাকায় যথেষ্ট সম্মানের সাথে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। মৃত এই ব্যক্তি ২০১৮ সালে প্রথম স্ত্রী রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করেন এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে সংসার জীবনে একজন পুত্র সন্তানের জন্ম হয়, যার বর্তমান বয়স আড়াই বছর।
সরেজমিনে জানা যায়, মৃত ব্যক্তি সোলাইমান দীর্ঘদিন ধরে প্রথম স্ত্রীর সংসারের তিন কন্যা সন্তানের সাথে মামলা মোকাদ্দমায় জড়িত ছিল। হাটহাজারী থানা, হাটহাজারী নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে মেয়েদের নামে একাধিক লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়। লিখিত অভিযোগে দেখা যায়, বৃদ্ধ বাবাকে ভরণপোষণ না করে উল্টো তার সম্পদ লিখে দিতে জোরজবদস্তি করে নিজের প্রথম সংসারের তিন কন্যা সন্তান। সোলায়মানের জীবিতকালীন সময়ে অন্য সংবাদ মাধ্যমে দেয়া বক্তব্যের ভিডিওতে দেখা যায়, সে তার ছোট মেয়ের বিরুদ্ধে অত্যাচারের কথা বলে ছিল। তিনি বলেন, তার ছোট মেয়ে জায়গাসম্পত্তি নিয়ে তার উপর যথেষ্ট অত্যাচার করেন, তিনি আর সহ্য করতে পারছিলেন না।
সাহাবু অন্ধকারময় শীতের রাতে বিলের মাঝখানে কবরস্থানের পাশে একা যেয়ে তার শ^শুরকে বিষ খাওয়া অবস্থায় উদ্ধার করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সোলায়মানের মেজ মেয়ের স্বামী সাবু বলেন, গত ৪ই ডিসেম্বর রাত আনুমানিক নয়টায় আমার শ্যালিকা জান্নাতুল ফেরদৌস (স্কুল শিক্ষিকা) তার বাবার অবস্থান সম্পর্কে আমাকে মোবাইলে জানালে আমি কবরস্থানের পাশে যাই, সেখানে যেয়ে বিষ খাওয়া অবস্থায় শ^শুড়কে পড়ে থাকতে দেখি। সেখান থেকে তার মেয়েরা বা পরিবারের কেউ বিষ খাওয়া শ^শুড়কে হাসপাতালে না নিয়ে গেলে আমি নিজেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে জরুরী বিভাগে ভর্তি করাই এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুদিন পর আমার শ্বশুর মৃত্যুবরণ করেন।
হাসপাতালে তারা পিতাকে দেখতে না যাওয়া, বা পিতার মৃত খবর পেয়েও তার পাশে না থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ছোট মেয়ে জান্নাতকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সেদিন রাতে আমার বাবা আমাকে ফোন করে বলে আমি আওলার দিঘির পাড়ে মাযারের কবরস্থানের পাশে বসে আছি আমাকে এসে নিয়ে যাও। তাই আমি আমার মেজ বোনের স্বামীকে ফোন করে সেখানে যেতে বলি। প্রতিবেদক তার ছোট মেয়ে জান্নাতের সাথে কথা বলার সময় দেখা যায়, তার ফোনে কে যেন ফোন করছে, আর সাংবাদিকদেরকে জান্নাত কিভাবে কথা বলবে তা শিখিয়ে দিচ্ছে। প্রশ্নের এক পর্যায়ে জান্নাত বলেন, সাহাবুরা যদি আমার ব্যাপারে কিছু বলে তাদের রেকর্ডও আমার কাছে আছে। আমিও সব ফাস করে দিবো।
সরজমিনে তদন্ত ও ডেথ সার্টিফিকেট দেখে জানা যায়, মৃত সুলাইমান ৪ই ডিসেম্বর রাতে বিষ পান করেন ও পরেরদিন ৫ই ডিসেম্বর ভোর ছয়টায় দশ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু নিয়ে এলাকায় বিভিন্ন রকম গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। এলাকায় কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, আমরা সেদিন রাত নয়টার দিকে কয়েকজন মানুষকে কবরপাড়ে দেখতে পেয়েছি। তবে অন্ধকারের মাঝে কারা ছিল সঠিক বুঝা যায়নি। আমরাও এলাকার মানুষ ভেবে তেমন একটা গুরুত্ব দেইনি। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা আরো জানান, পরের দিন সেখানে বিষের কৌটা ও রশি পড়ে থাকতে দেখেছি।
এ বিষয়ে মৃত সোলায়মানের ২য় স্ত্রী রিনা বেগমকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সোলায়মান আনুমানিক ১৫ দিন আগে আমার ঘর থেকে মেয়ের বাসায় যাচ্ছি বলে বেরিয়ে যান। রাতে সোলাইমান বাসায় ফিরে না আসার কারণে আমি তার মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলেও মোবাইল রিসিভ না করে তিনি মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে দেন। এরপর থেকে তার আর কোন সন্ধান পাই নাই। ১৫দিন পর তার বিষ খাওয়ার খবর শুনি, পরেরদিন তার মৃত্যুর খবর শুনতে পাই। স্বামীর বিষ খাওয়া ও মৃত্যুর খবর পেয়েও আপনার স্বামীকে দেখতে যান নাই কেন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি এই সব কিছুই জানিনা। আমাকে জানানো হয়নি।
তবে স্থানীয় প্রতিবেশী কয়েকজন বলেন, বিষ খাওয়ার দিন বিকাল বেলায় জান্নাতের বাড়িতে বৃদ্ধ সোলায়মানকে তার মেয়ের সাথে ঝগড়া করতে দেখেছে।
এ বিষয়ে হাটহাজারী থানার তদন্তকারী এস আই নুর এ আলম বলেন, বৃদ্ধ সোলায়মান বিষ খেয়ে আত্নহত্যা করেছে মর্মে হাটহাজারী থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। যার নং ৩৬।
এ বিষয়ে ইউপি সদস্য মোহাম্মদ মুছা বলেন, আমি সুলেমানের বিষ খাওয়া ও মৃত্যুর খবর পেয়েছি। তার বাড়ি এই এলাকায় না। কিন্তু এই এলাকায় তার মেয়েদের বাড়ি হওয়ার হয়তো সে এলাকায় এসেছে। এ এলাকায় তার বিষ খেয়ে মৃত্যুর বিষয় নিয়ে নানামুখী আলোচনা হলে আমিও প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা করবো।