বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী গৌতম আদানি ও তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ এখন বাংলাদেশেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। আদানি গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের করা বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় চুক্তি পুনরায় খতিয়ে দেখার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি মার্কিন আদালতে আদানি গ্রুপের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এতে ভবিষ্যতে আদানি গ্রুপ ও বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ চুক্তির ওপর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন মনে করেন, আদানি গ্রুপের সঙ্গে করা ১,৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি প্রথম থেকেই বিতর্কিত। টেন্ডার প্রক্রিয়ার বাইরে এই চুক্তি হওয়ায় সমালোচনা দীর্ঘদিন ধরে ছিল।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে এই অভিযোগপত্রের পর বাংলাদেশ এখন আদানির সঙ্গে মূল্য পুনর্বিবেচনার সুযোগ নিতে পারে। বিশেষ করে কয়লার দাম সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
২০১৭ সালে আদানি পাওয়ার লিমিটেডের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল থার্মাল ইউনিট থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিলে। চুক্তির শুরুতে এটি বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের একটি কার্যকর উদ্যোগ বলে মনে করা হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিতর্ক বাড়তে থাকে।
সমালোচকরা বলছেন, ভারত সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি পাওয়া সত্ত্বেও আদানি বাংলাদেশকে কোনো আর্থিক সুবিধা দেয়নি। বরং কয়লার দাম অতিরিক্ত চাওয়ার অভিযোগও উঠেছে।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) আদানি গ্রুপকে কয়লার দাম কমানোর অনুরোধ করে। আদানি প্রতি মেট্রিক টন কয়লার দাম ৪০০ ডলার দাবি করলেও, বিপিডিবি যুক্তি দেয় যে দামটি ২৫০ ডলারের কম হওয়া উচিত।
আগস্ট ২০২৪-এ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি চুক্তিগুলো পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত একটি বিশেষ কমিটি আদানি চুক্তিসহ অন্যান্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প খতিয়ে দেখতে শুরু করে।
নতুন অন্তর্বর্তী সরকার আদানি পাওয়ারের বকেয়া বিল পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিলেও, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের হুমকি বিষয়টিকে আরও জটিল করে তোলে। এরপর আদালতের নির্দেশে এই চুক্তি নিয়ে পুনর্মূল্যায়ন শুরু হয়।
ঢাকার হাইকোর্টের নির্দেশনায় আদানির সঙ্গে করা বিদ্যুৎ চুক্তি পুনরায় পর্যালোচনা করার পথ সুগম হয়েছে। বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই চুক্তির আর্থিক এবং পরিবেশগত প্রভাব, বিশেষ করে কয়লার উচ্চমূল্য নিয়ে নতুন করে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ সরকারের সামনে এখন প্রশ্ন, আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি কীভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখা হবে। মার্কিন মামলার কারণে আন্তর্জাতিক পরিসরে আদানি গ্রুপের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশ কি এই চুক্তি থেকে বাড়তি সুবিধা নিতে পারবে?
অন্যদিকে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ চুক্তি একটি সরকারি স্তরের বিষয় এবং তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশকে এখন একটি কৌশলগত অবস্থানে থেকে এই চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।
আদানি গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চুক্তি নতুন সংকট ও সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। উচ্চমূল্যের কয়লা আমদানি, পরিবেশগত প্রভাব, এবং আন্তর্জাতিক অভিযোগ- এই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সামনে এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।
বায়ান্ন/এএস/একে