বাংলার পাটের গৌরব বেশ পুরোনো। আর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থনীতিতে যে গোড়াপত্তন হয়েছিল সেখানেও প্রধান অর্থ উপার্জনকারী ফসল ছিল এই পাট। যা স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে অনেকটাই ম্লান হয়ে পড়েছে। নগণ্য হয়ে গেছে রপ্তানি আয়ে পাটের অবদান।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানি আয়ে পাট ও পাটজাত পণ্যের অংশীদারিত্ব ছিল ৮৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সে বছর সর্বমোট রপ্তানি আয় ছিল ৩৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। এর মধ্যে শুধু পাট রপ্তানি ৩১ কোটি ডলারের বেশি। কাঁচা পাট রপ্তানি হয়েছিল ১৩ কোটি ডলারের এবং পাটজাত পণ্য ছিল ১৮ কোটি ডলারের।
অন্যদিকে গত অর্থবছরে (২০২০-২১) পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি আয় ১১৬ কোটি ১৪ লাখ ডলার। এ পাঁচ দশকে দেশের সার্বিক রপ্তানি আয় ঠেকেছে ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি ডলারে, যেখানে পাটের আয় মাত্র ২ দশমিক ৯৯ ভাগ। অর্থাৎ পাঁচ দশকে পাট রপ্তানির আর্থিক মূল্য বাড়লেও মোট রপ্তানিতে পাটের অবদান প্রায় ৮৭ ভাগ কমে গেছে। সে জায়গা দখল করেছে পোশাক, ওষুধসহ অন্যান্য পণ্য।
শুধু রপ্তানি নয়, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে কয়েক দশক সোনালি সময় পার করেছে পাটশিল্প। ১৯৭২ সালে দেশে ৭৮টি পাটকল নিয়ে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আশির দশক পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প ছিল এটি। সে সময় বিজেএমসি জনবলের দিক থেকে দেশের বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান। যেখানে প্রায় ৭০ হাজার শ্রমিক এবং সাড়ে পাঁচ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী সরাসরি নিযুক্ত ছিলেন। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও আয়ের দিকেও এ শিল্প ছিল শীর্ষে।
পরবর্তী ১৯৮১ সালে সংস্থাটির মিলের সংখ্যা বেড়ে হয় ৮২টি। এরপর থেকে লোকসানে পড়তে থাকে মিলগুলো। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের সময় ৩৫টি পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। আটটি পাটকলের পুঁজি প্রত্যাহার করা হয় এবং ১৯৯০ সালের পর বিশ্বব্যাংকের পাট খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় ১১টি পাটকল বন্ধ, বিক্রি ও একীভূত করা হয়। ২০০২ সালের জুনে বন্ধ হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ আদমজী জুট মিল এবং এবিসি মিল।
যদিও এখনও পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আধিপত্য বিরাজমান। বিশ্বের মোট পাট রফতানির ৭৯ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ। সরকার পাটের বাজার থেকে সরে আসার পরে বেসরকারি উদ্যোগ এ খাতকে উজ্জীবিত রেখেছে।
এরপর বিজেএমসির অধীনে থাকা ২৬টি পাটকলের মধ্যে ২০২০ সাল পর্যন্ত চালু ছিল ২৫টি। এগুলোর মধ্যে ২২টি পাটকল ও ৩টি ননজুট কারখানা। ওই সময় ক্রমাগত লোকসানের কারণে সরকারি আদেশে বিজেএমসি’র নিয়ন্ত্রণাধীন মিলগুলোর শ্রমিকদের চাকরি গোল্ডেন হ্যান্ডশেক সুবিধার আওতায় অবসানসহ উৎপাদন কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। একদম থমকে যায় পাটের গল্প।
এমনই এক প্রেক্ষাপটে ‘সোনালি আঁশের সোনার দেশ, পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশ’ এই স্লোগানে রোববার (৬ মার্চ) পালিত হচ্ছে জাতীয় পাট দিবস-২০২২। দিবসটি উপলক্ষে পাট ও পাটজাত পণ্যের উৎপাদন এবং রপ্তানির প্রতিশ্রুতির কথা বলে যাচ্ছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।
সরকার বলছে, বর্তমানে কৃত্রিম তন্তুর (পলিথিন) ব্যবহার বৃদ্ধি পেলেও টেকসই উন্নয়নের যুগে আবারো বিশ্বব্যাপী পরিবেশবান্ধব পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে পাট রপ্তানি বৃদ্ধি, পাটজাত পণ্যের প্রসার ও বাজার সম্প্রসারণ, দেশের অভ্যন্তরে পাটপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধিসহ নানা উদ্যোগে পাটের হারানো সুদিন ফেরানো সম্ভব। এ লক্ষ্যে আবারও পাটকলগুলো খুলে দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পাটকলগুলো ইজারা দিয়ে পাটের সুদিন ফেরানোর কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। এরই মধ্যে নরসিংদীর বাংলাদেশ জুট মিল এবং চট্টগ্রামের কেএফডি জুট মিলস ভাড়াভিত্তিক ইজারা দেওয়ার হয়েছে। আরও দুটি পাটকল ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান। অবশিষ্ট ১৩টি পাটকল ইজারা দিতে দ্বিতীয়বারের মতো আগ্রহপত্র আহ্বান করা হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ পাটকলগুলো চালু হবে।
এদিকে পাটকল বন্ধ থাকায় পাটচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে কৃষক। আগে যেখানে ধান চাষের পরই কৃষকরা পাটে আগ্রহী ছিলেন, এখন সে জায়গা দখল করেছে অন্যান্য ফসল। ফলে দিন দিন কমে যাচ্ছে পাট চাষের জমির পরিমাণ।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ৭৭ লাখ টন কাঁচা পাট উৎপাদিত হয়েছে। দেশে মাত্র সাড়ে সাত লাখ হেক্টর জমিতে এখন পাটের আবাদ হচ্ছে। যেখানে কয়েক বছর আগেও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ লাখ ৪৯ হাজার হেক্টর জমিতে ৮৫ লাখ ৭৬ হাজার টন পাট উৎপাদন হয়েছিল।
ফলে দেশের বেসরকারি পাটকলগুলোও ঠিকমতো পাটের সরবরাহ পাচ্ছে না। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কমায় গত কয়েক বছর কাঁচা পাটের মূল্যবৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন পাটকল মালিকেরা। দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক উদ্যোক্তাই পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতায় কারখানা চালাতে পারছেন না। কেউ কেউ উৎপাদন বন্ধ রেখেছেন বলেও দাবি করা হচ্ছে গত দুই বছর ধরে।