ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০
দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা চায় লক্ষ্মীপুরবাসী

আর্সেনিক ও আয়রনযুক্ত পানি সরকারি ও বেসরকারি নলকূপে

মু.ওয়াহিদুর রহমান মুরাদ ,লক্ষ্মীপুুর | প্রকাশের সময় : শুক্রবার ২৪ মার্চ ২০২৩ ০৭:৫০:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর

 

লক্ষ্মীপুরের গ্রামগঞ্জের বেশিরভাগ মানুষ এখনো অ-গভীর এবং শ্যালো টিউবয়েলের পানি পান করছেন। যাতে আর্সেনিক এবং আয়রনের উপস্থিতি রয়েছে।পৌর শহরের পাশাপাশি জেলার উপকূলীয় এলাকার টিউবওয়েলগুলো থেকে উঠছে নোনা পানি। 

ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেশিরভাগ বাসিন্দারা এখনো সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।বাধ্য হয়ে আর্সেনিক ও আয়রনযুক্ত পানি পান করছেন তারা। 

অন্যদিকে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার বাসিন্দারাও পানি নিয়ে দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছেন।শুধুমাত্র পৌর শহর বা এর আশপাশে পৌর কর্তৃপক্ষ পানি সরবরাহ করলেও শহরের অদূরের গ্রাম এবং পৌরসভার বর্ধিত অংশে এখনো পৌঁছাতে পারেনি সুপেয় পানির লাইন। আবার পৌরসভার কোনো এলাকায় পানি সরবরাহ লাইন থাকলেও সেখানে ঠিকমতো এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পাওয়া যাচ্ছে না পানি। ফলে ওইসব এলাকার বাসিন্দারা বাধ্য হয়ে অগভীর নলকূপ কিংবা শ্যালো টিউবওয়েলের পানি পান করছে। যাতে আর্সেনিক এবং আয়রন দুটোই রয়েছে। 
অন্যদিকে গভীর নলকূপের পানি নিরাপদ হলেও জেলার বাসিন্দাদের চাহিদা অনুযায়ী যা একেবারেই অপ্রতুল্য। শুধুমাত্র বিত্তশালী এবং জনপ্রতিনিধিদের আস্থাভাজনরাই গভীর নলকূপের সুবিধা পেয়ে থাকে। অন্যদের ভরসা আর্সেনিক ও আয়রনযুক্ত পানি। আবার দুর্গম চরগুলোতে নোনা পানির আধিক্য থাকায় সেখানকার বাসিন্দারা সুপেয় পানির জন্য দুর্ভোগে পড়েন। এতে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে জেলার বাসিন্দারা। 

সম্প্রতি লক্ষ্মীপুরের অ-গভীর এবং শ্যালো টিউবওয়েলগুলোতে আর্সেনিক নিয়ে একটি জরিপ চালায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। এতে আর্সেনিকের ভয়াবহতা উঠে এসেছে।

জেলার সদর উপজেলার পৌরসভা এবং ১৮টি ইউনিয়নের ৩৯ হাজার ৯৫৭টি অগভীর এবং শ্যালো টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়। যার মধ্যে ১৬ হাজার ৯৩৭টি অগভীর নলকূপ ও শ্যালো টিউবওয়েলে আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। প্রতি ইউনিয়ন থেকে আড়াই হাজার টিউবওয়েলের নমুনা পানি সংগ্রহ করে জনস্বাস্থ্য অধিদফতর। 

জরিপে সদর উপজেলার কুশাখালী ইউনিয়নের কাঁঠালী গ্রামে আনুপাতিক হারে আর্সেনিকের উপস্থিতি কম পাওয়া গেলেও সবচেয়ে বেশি আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে ভবানীগঞ্জ এবং দক্ষিণ হামছাদী ইউনিয়নে। পৌর এলাকার ২০২৩টি নলকূপের পানি পরীক্ষা করে ৭২৫টিতেই আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। 

আর্সেনিকযুক্ত টিউবওয়েলের পানি রান্নার কাজে ব্যবহার এবং পান করা থেকে বাসিন্দাদের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও সুপেয় পানির বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তারা বাধ্য হয়ে ওইসব টিউবওয়েলের পানিই পান করছেন। আবার প্রায় বেশিরভাগ অগভীর নলকূপে আয়রনের প্রভাব রয়েছে। বাধ্য হয়েই অনেকেই সেই আয়রনযুক্ত পানিই পান করছেন। 

লক্ষ্মীপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর বলছে, আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসনে একটি প্রকল্প ছিল। এতে সদর, রামগঞ্জ এবং রায়পুর উপজেলাতে ২০০৯ সাল নাগাদ ৩৫ হাজার অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। 

বর্তমানে বিভিন্ন ইউনিয়নে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ প্রকল্পের কাজ চলছে। বিশেষ করে সদর উপজেলার টুমচর এবং ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নে 'সমগ্র বাংলাদেশে পাইপ লাইনে পানি সরবরাহ প্রকল্প' এর আওতায় দুটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে উৎপাদক গভীর নলকূপের সাহায্যে ইউনিয়নের ৫ কিলোমিটার এলাকার আড়াইশ পরিবারকে সুপেয় পানি সরবরাহ করা যাবে। এছাড়া তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের জন্য 'মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প' এর আওতায় আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর।

প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে সাড়ে ৩শ পরিবারকে এবং পরবর্তী ৫ বছরের মধ্যে ৭০০ পরিবারকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হবে। 

এছাড়া যেখানে আয়রনের পরিমাণ বেশি পাওয়া গেছে, সেখানে আয়রন শোধনের জন্য পরিবেশবান্ধব ওয়াটার ডিসাইলেশন ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। পাইলট প্রকল্পের আওতায় জেলার সদর উপজেলায় ৬৫টি এবং রামগতিতে ১৪টি ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। তবে পাইলট প্রকল্পকে মূল প্রকল্পে আনা হলে উপকারভোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল। 

এদিকে জেলার উপকূলীয় এলাকা রামগতি এবং কমলনগরে অগভীর টিউবওয়েলে আয়রন এবং লবণের উপস্থিতি রয়েছে ব্যাপক হারে। রামগতি পৌরসভা (আলেকজান্ডার) এবং চর বাদাম ইউনিয়নে গভীর নলকূপ স্থাপন করেও পাওয়া যাচ্ছে না সুপেয় পানি। তবে উপজেলার পৌর এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে সুপেয় পানি সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে 'সারা দেশের ৩০ পৌরসভায় পানি সরবরাহ প্রকল্প' এর আওতায় আলেকজান্ডারে একটি পানির ট্যাংক স্থাপন করা হচ্ছে। মেঘনা নদীর খুব কাছাকাছি হওয়ায় ওই এলাকার মাটির তলদেশে সুপেয় পানির অভাব থাকায় প্রকল্প এলাকা থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে চর আলগীতে চারটি উৎপাদক নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। সেখান থেকেই আলেকজান্ডারে অবস্থিত ট্যাংকে পানি নিয়ে আসা হবে। ওই ট্যাংক থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পৌরবাসীকে সুপ্রেয় পানির যোগান দেওয়া হবে। 

চাহিদার তুলনায় নগন্য অ-গভীর নলকূপ:

লক্ষ্মীপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর থেকে সুপেয় পানির জন্য নানা প্রকল্প এবং গভীর নলকূপ স্থাপন করা হলেও জেলার বাসিন্দাদের চাহিদা অনুযায়ী তা একেবারে অপ্রতুল্য। এছাড়া এসব প্রকল্পের সুবিধা শুধুমাত্র বিত্তশালী এবং জনপ্রতিনিধিদের আস্থাভাজনরাই ভোগ করতে পারে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর থেকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক গভীর নলকূপের বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে সাধারণ জনগণ এসব সুবিধার বাহিরে থাকে। সরকার নির্ধারিত নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ থেকেও কয়েকগুণ বেশি অর্থের বিনিময়ে নিতে হয় গভীর নলকূপ। আবার পৌর এলাকার নিজস্ব উদ্যোগে গভীর নলকূপ স্থাপনে রয়েছে পৌরসভার নানা প্রতিবন্ধকতা। ফলে পৌর এলাকাসহ জেলার অধিকাংশ মানুষ আর্সেনিক এবং আয়রনযুক্ত পানিই পান করছে।

আর্সেনিক এবং আয়রনযুক্ত পানির ভয়াবহতার কথা জানিয়ে সদর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের উপসহকারী প্রকৌশলী ফাতেমা-তুজ-জোহরা  বলেন, আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করা মানে বিষপান করা। এ পানি পান করলে হৃদরোগ, চর্মরোগ, এলার্জি ও স্কিন ক্যানসারসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হবে। এছাড়া পানিতে আয়রনের মাত্রা বেশি থাকলে চুল পড়ে যাবে।  তিনি বলেন, গভীর নলকূপে আর্সেনিক থাকে না। তবে আমাদের চাহিদার তুলনায় গভীর নলকূপ একেবারে নগন্য। উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে গেল ৪ অর্থবছরে জেলার প্রতিটি উপজেলাতে ২৬টি করে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। 'সমগ্র বাংলাদেশে পানি সরবরাহ প্রকল্প' এর আওতায় কিছু কিছু ইউনিয়নে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হবে। সুপেয় পানির চাহিদার তুলনায় এসব প্রকল্পের সুবিধাভোগীর সংখ্যাও একেবারে কম বলে স্বীকার করেন তিনি।