প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপহারের চিলাবাড়ী আশ্রয় কেন্দ্রে ভুতুরে বিদ্যুৎ বিলের উপদ্রবে দিশেহারা হয়ে পরেছেন গৃহহীন ৪০ পরিবারের সদস্যরা। সহায় সম্বলহীন হওয়া সত্বেও বিদ্যুৎ বিলের ভোগান্তির শিকার এখন টাঙ্গাইল সদর উপজেলার দাইন্যা ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের চিলাবাড়ী আশ্রয় কেন্দ্রের গৃহহীন ওই পরিবারগুলো। বিলাসী জীবন যাত্রা মানুষ না হয়েও প্রায় প্রতি মাসে তাদের গুণতে হচ্ছে এক থেকে দেড় হাজার টাকার বিদ্যুৎ বিল। বিদ্যুৎ বিভাগের এমন হয়রানীর অভিযোগ তুলেছেন গৃহহীন ওই পরিবারগুলোর সদস্যরা।
এছাড়াও পয়ঃনিষ্কাশন, জলাবদ্ধতা, যাতায়াত ব্যবস্থা, গৃহনির্মাণে ত্রæটিসহ নানা সমস্যায় দিন কাটাচ্ছেন আশ্রয় কেন্দ্রের ওই গৃহহীনরা। সমস্যা সমাধানে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনসহ বিদ্যুৎ বিভাগের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।
জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার দাইন্যা ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের চিলাবাড়ী আশ্রয় কেন্দ্র নির্মিত হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, দুই বছর যাবৎ চিলাবাড়ী আশ্রয় কেন্দ্রে বসবাস করছেন ৪০টি পরিবারের প্রায় দেড় শতাধিক সদস্য। দুই শতাংশ জমিসহ উপহারের ঘরে বসবাস করার পাশাপাশি বাড়তি জমিতে আবাদ করেছেন পেঁপে, লাউ, বটবটি, কাঠালসহ নানা প্রজাতির ফলজ ও সবজির গাছ। দৈনিক উপার্জনের টাকা আর সবজিই দিচ্ছে তাদের খাওয়ার যোগান।
চিলাবাড়ী আশ্রয় কেন্দ্রে বসবাসরত গৃহিনী তিসার বৈদ্যুতিক কাস্টমার নং-৯৭০৯২৭৬৪ ও মিটার নং-১৬৮০৪০। তার অভিযোগ, চলতি বছরের ২৮ আগস্ট বিদ্যুৎ বিল ১৬৭০, সেপ্টেম্বর মাসে ১৯১৫ আর অক্টোবর মাসে বিল এসেছে ১৩৯৫ টাকা। প্রতি মাসে তার এই পরিমাণ টাকার বিল আসলেও আশ্রয় কেন্দ্রের কোন কোন বাড়িতে বিলই দেয়া হচ্ছেনা। ভুতুরে ওই বিদ্যুৎ বিল আসায় তারা চরম ভোগান্তি আছেন। বিদ্যুৎ বিলের টাকা পরিশোধ করতেই হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রে বসবাসরত তাদের অংশের ১০ ঘরের জন্য একটি টিউবওয়েলের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বরাদ্দের টিউবওয়েলের পানিতে আয়রন থাকায় তাদের খাওয়াসহ ব্যবহারে চরম সমস্য হচ্ছে। এছাড়াও নেই ড্রেন ও যাতায়াতের রাস্তা। এ কারণে ব্যবহৃত পানি যাচ্ছে অন্যের জমিতে আর হাটা চলাও করতে হচ্ছে অন্যের জমির উপর দিয়ে। ব্যবহৃত ওই পানি আর হাটা চলার কারণে প্রায় প্রতিদিনই তাদের শুনতে হচ্ছে প্রতিবেশীদের কটু কথা।
গৃহিনী শাহনাজ এর বৈদ্যুতিক কাস্টমার নং-৯৭০৯০৫৬০ ও মিটার নং-১০৭০৩৯। চলতি বছরের ২৮ আগস্ট বিদ্যুৎ বিল ১০২৫, সেপ্টেম্বর মাসে ১২৭৮ আর অক্টোবর মাসে বিল এসেছে ১৪৭৭ টাকা। রিকসা চালক স্বামীসহ তিন সদস্যের সংসার তার। ঘরে একটা ফ্রিজ, রাইস কুকার, ফ্যান আর লাইট ব্যবহার করি। মিটার দেখতে কেউ না আসলেও প্রায় প্রতি মাসেই তাকে বিল দিতে হচ্ছে পনের থেকে দুই হাজার টাকা।
তিনি বলেন, গরীব মানুষ বলেই তো আমরা আশ্রয় কেন্দ্রে আসছি। এরপরও আমাদের গুণতে হচ্ছে ভুতুরে ওই বিদ্যুৎ বিলের টাকা। এত টাকা পরিশোধ করতে চরম কষ্ট হয় বলেও জানান তিনি।
আশ্রয় কেন্দ্রের গৃহিনী আন্না খাতুন বলেন, যারা ব্যাটারী চালিত ভ্যানসহ নানা ধরণের জিনিস চার্জ দিচ্ছেন, তাদের বিদ্যুৎ বিল এক থেকে দেড়শ টাকা বিল আসলেও আমি ঘরে একটা ফ্যান আর বাল্ব ব্যবহার করি তাতেই প্রতিমাসে বিল আসছে সাত-আট’শ টাকা। গরীব মানুষ বলেই তো আমরা আশ্রয় কেন্দ্রে থাকি, ধনী হলে তো এখানে থাকতাম না। এত বিদ্যুৎ বিল আসায় চরম কষ্টে আছি। বিদ্যুৎ অফিসে বাড়তি বিলের বিষয়ে জানানো হলেও তারা বলেন বিল যা আসবে তাই দিতে হবে। আমরা গরীব মানুষ হওয়ায় তারা আমাদের কথা শুনেন না।
গৃহিনী রাহেলা খাতুন বলেন, একটা ফ্রিজ, ফ্যান আর লাইট ব্যবহার করি, তাতেই বিদ্যুৎ বিল আসছে ১৪-১৫’শ টাকা। এই মাসে ১৪৭৭ টাকা বিল এসেছে। আমরা গরীব মানুষ এত টাকা বিল দিলে খামু কি। এছাড়াও পায়খানায় ময়লা জমে গেছে। সেটি ফেলার মত কোন জায়গা না থাকায় চরম কষ্টে আছি। এছাড়াও ঘর গুলো তৈরিতে রয়েছে অনেক সমস্যা। হাত দিয়ে চিমটি দিলে খসে পরছে ঘরের প্লাস্টার। ড্রেনের ব্যবস্থাসহ চলাচলের রাস্তা না থাকায় বেশি কষ্ট ভোগ করছেন তারা।
আইয়ুব আলী বলেন, এক বছর হলো এই আশ্রয় কেন্দ্রে বসবাস করছি। বেশ কয়েকদিন যাবৎ পানির ট্যাংকির সমস্যায় আছি। পানি ব্যবহার করতে পারছিনা। টানা বৃষ্টির কারণে ট্যাংকির নিচের মাটি সরে যাওয়ায় ট্যাংকিতে পানি উঠানো যাচ্ছেনা। এ কারণে ট্যাংকির পানি ব্যবহার বন্ধ রয়েছে। ট্যাংকির পানিতে পর্যাপ্ত আয়রন। এরপরও ট্যাংকির পানি সরবরাহ ঠিক থাকলে তাদের পানি সমস্যা অনেকটা লাঘব হয়।
তিনি আরও বলেন, আশ্রয় কেন্দ্রের তাদের অংশের ১৬টি ঘরের খাওয়ার পানির চাহিদা মিটাতে একটি টিউবওয়েল দেয়া হয়েছে। তবে বসবাসরত ৫০ সদস্যের ওই একটি টিউবওয়েল ব্যবহার কষ্টকর বলেও জানান তিনি।
আশ্রয় কেন্দ্রে এক বছর যাবৎ বসবাস করছেন ঝর্না বেগম। তিনি বলেন, থাকার জমি ছিল না প্রধানমন্ত্রী থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এখানে আমরা ভালো আছি। পরিবারের সবজি খাওয়ার যোগান দিতে বাড়তি জমিতে লাউ আর বটবটি আবাদ করছি।
দাইন্যা ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ড চিলাবাড়ী গ্রামের ইউপি সদস্য শহীদ সরকার বলেন, ড্রেন, যাতায়াতের সড়র না থাকাসহ টিউবওয়েলের পানিতে আয়রন উঠায় চরম সমস্যায় রয়েছে বলে আশ্রয় কেন্দ্রের বাসিন্দারা তার কাছে অভিযোগ করেছেন। তবে এ বিষয় গুলো দেখভালের দায়িত্বে আছেন উপজেলা প্রশাসন। তিনি বলেন, এই গ্রামে টিউবওয়েলের জন্য ৬০ ফুট পাইপ গাড়লেই ভালো পানি পাওয়া যেত, সেখানে টিউবওয়েলের পাইপ গাড়া হয়েছে দুই’শ ফুট। এ কারণে ওই পানিতে আয়রন উঠছে।
টাঙ্গাইল বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শাহগির হোসেন জানান, আশ্রয় কেন্দ্রে কয়েকটি ডিজিটাল মিটার রয়েছে, এছাড়া বেশির ভাগই প্রিপেইড মিটার। তবে ডিজিটাল মিটারেও ভৌতিক বিল বা গড় বিল করার সুযোগ নেই। এছাড়াও কেউ আমাকে এমন কোন অভিযোগ করেননি। এরপরও যদি এখন কোন ভুক্তভোগী থেকে থাকেন, তিনি অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
চিলাবাড়ী আশ্রয় কেন্দ্রের, যাতায়াতের সড়ক, জলাবদ্ধতা, ড্রেনেজ ও পয়ঃনিষ্কাশনের সমস্যার কথা শিকার করে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রানুয়ারা খাতুন জানান, নদী সংলগ্নে আশ্রয় কেন্দ্র গুলোর ড্রেনেজ ও পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চিলাবাড়ী আশ্রয় কেন্দ্রের আশপাশে কোন নদী বা খাল না থাকায় ড্রেনেজ ও পয়ঃনিষ্কাশনের সমস্যা নিরসন সম্ভব হয়নি। তবে সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি আরও জানান, টিউবওয়েল স্থাপনের কাজ করেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ। টিউবওয়েলের পানিতে পর্যাপ্ত আয়রন থাকায় ওই পানি ব্যবহার করতে সমস্যা হচ্ছে এমন অভিযোগ পেয়েই জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। তবে কেন এখনও পানির সমস্যা নিরসন করা হয়নি বিষয়টি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানতে পারবো। দ্রæতই পানির সমস্যা সমাধান করা হবে বলে আশ^াস প্রকাশ করেছেন তিনি।
এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ইবনে মায়াজ প্রামানিক জানান, টাঙ্গাইলের পানিতে পর্যাপ্ত আয়রন। পানি ব্যবহারের উপযোগী করতে আশ্রয় কেন্দ্রের টিউবওয়েলে ফিল্টার স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আশা করছি খুব দ্রæতই কার্যক্রম শুরু করা যাবে।