ঢাকা, রবিবার ১৯ মে ২০২৪, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

শাবিপ্রবির বাতাস যেন ভারী হয়ে আসছে, সমাধানের অপেক্ষায় শিক্ষার্থীরা

রাহাত হাসান মিশকাত, শাবিপ্রবি : | প্রকাশের সময় : শনিবার ২২ জানুয়ারী ২০২২ ০৬:৫৮:০০ অপরাহ্ন | শিক্ষা

শাবিপ্রবি (সিলেট): এ যেন শরণার্থী শিবিরের অস্থায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এ যেন মৃত্যুর জন্যে পথ চেয়ে বসে থাকা। হাঁড় কাঁপানো এমন দীর্ঘতম শীতের রাত, যেন নতুন সুর্যের অপেক্ষা। উপরে ত্রিপাল, চারপাশে কাপড়ের প্রাচীরে ঘেরা মাঝখানে মুমূর্ষু রোগীর মতো স্ট্যান্ডে ঝুলানো স্যালাইন নিয়ে শুয়ে আছে অনশনরত শিক্ষার্থীরা। অনশনের তিনদিন পেরিয়ে মাটি আর পিঠ এক হয়ে গেছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তারা। শরীর অতিরিক্ত দূর্বল হয়ে যাওয়ায় পুশ করা আছে স্যালাইন। এরই মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ  বেঁজে উঠে এম্ব্যুালেন্সের সাইরেন। সাইরেনের আওয়াজে ভারি হয়ে উঠে চারপাশ। কষ্টে কাতরানো এ শিক্ষার্থীদের চারপাশ ঘিরে বসে আছে শক্তি যোগাতে আসা সহযোদ্ধারা। অনশনে বসা  বন্ধু, সহপাঠী, জুনিয়র কিংবা সিনিয়রদের গভীর মমত্বে যত্ন নিচ্ছেন কেউ কেউ। কখনো কখনো অনশনরত শিক্ষার্থীদের কষ্ট দেখে নিরবে চোখের জল ফেলছেন কেউ কেউ। এমন চোখ হৃদয় বিদারক  দৃশ্যের দেখা মিলবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) ক্যাম্পাসে।

 

রোববার (১৬ জানুয়ারি) শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশের নির্বিচারে লাঠিচার্জ, গুলিবর্ষণ আর সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ার পরে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্ধীরা। এই দাবিতে বুধবার (১৯ জানুয়ারি) দুপুর পৌঁনে ৩টা থেকে ২৪ জন শিক্ষার্থী আমরণ অনশনে বসেন। অনশনের ২৪ ঘণ্টা পার হবার পর থেকে এক এক করে ১৪ জন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এরই মধ্যে কয়েকজন শিক্ষার্থীর অবস্থা আশঙ্খাজনক বলে জানান ডাক্তাররা। বাকিদের অনশনরত স্থানে শরীরে স্যালাইন ঢুকানো আছে। এতে শুক্রবার (২১ জানুয়ারি) মরিয়ম নামের এক শিক্ষার্থী তার নানার মৃত্যুর সংবাদ শুনেন, তা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেও অনশন অব্যাহত রাখেন তিনি। মরিয়ম বলেন, ‘আমি আমার নানাভাইকে শেষ বারের মতো একবার দেখতে চাই। তবে আমি অনশনে থেকেই নানাকে দেখতে যাব’।

 

এদিকে অসুস্থ ১৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে কাজল দাস ও আব্দুল্লাহ আর রাফি দুইজন শিক্ষার্থী মেডিকেল থেকে ক্যাম্পাসে ফিরে আবারো অনশন করছেন। 

আব্দুল্লাহ আর রাফি বলেন, 'আমার প্রেশার লো, সুগার লো এবং শরীর নিস্তেজ হয়ে যাওয়ায় হাসপাতালে আসতে হয়েছে। একটু সুস্থ বোধ করলে আমি আবারও ক্যাম্পাসে ফিরে অনশন চালিয়ে যাবো।'

 

রাফি বলেন, 'শরীর একটু স্বাভাবিক বোধ করায় আমি আবার এসেছি। আমার সঙ্গের এরা এখানে শীতের মাঝে কষ্ট করছে, আমি যতক্ষণ স্বাভাবিক আছি ততক্ষণ এখানে থাকতে চাই। আর পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমি অনশন চালিয়ে যাবো।'

 

চলমান পরিস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের সঙ্গে বসে কথা বলতে চায়। এজন্য মন্ত্রী তাদেরকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানায়। প্রথমে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি দল ঢাকায় যাওয়ায় কথা বললেও পরবর্তীতে অনশনরত এক শিক্ষার্থী আলোচনায় অংশ নিতে চাইলে তাকে ছেড়ে ঢাকায় যাবার সিদ্ধান্ত বাতিল করে। পরে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে অথবা মন্ত্রীকে সিলেটে এসে আলোচনার আহবান জানান শিক্ষার্থীরা। তবে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিরা দল মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে ঢাকায় না গেলেও শিক্ষকদের পাঁচ সদস্যের একটি টিম মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে ঢাকা গেছেন বলে জানা যায়।

 

দায়িত্বপালনরত চিকিৎসক মো. মোস্তাকিম বলেন, 'আমরা ১৫ জন চিকিৎসক তাদের সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি। এখানে ১২ শিক্ষার্থী অনশনরত অবস্থায় আছেন। তাদের মধ্যে কারো গ্লুকোজ লেভেল কমে গেছে। কারো ব্লাড প্রেশার লো হয়ে গেছে। আমরা তাদের স্যালাইন দিয়েছি। যারা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তাদের মেডিক্যালে রেফার করা হচ্ছে। এদের মধ্যে একজন এজমা রোগের শিক্ষার্থী, রাতে বেশি শীত থাকায় তার শ্বাসকষ্ট বেড়েছে। তাই তাদের পালস বেশি হচ্ছে। দীর্ঘ সময় না খাওয়ার কারণে এই সমস্যা হচ্ছে। এভাবে না খেয়ে থাকলে শারীরিক সমস্যা আরও বাড়বে।'

 

কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, 'আমরা তোমাদের সমস্যার সমাধান আলোচনার মাধ্যমে বসে করতে। আমরা চাইনা এ ক্যাম্পাসে কেউ কোন ধরনের স্বৈরচারী আচরণ করুক। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। সেদিন তোমাদের তিন দফা দাবির সমধান হয়ে গেছিলো। শুধুমাত্র ঘোষণাটা বাকি ছিলো। কেন হঠাৎ এমন হয়েছে? তা তদন্ত সাপেক্ষে বের করার জন্য আমরা উচ্চ মহলের কাছে

উদাত্ত্ব আহ্বান জানাচ্ছি।'

 

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেন, 'তোমাদের সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী আলোচনা করছেন। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে তোমাদের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা গিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে আলোচনা করার আহ্বান জানান শিক্ষামন্ত্রী। প্রতিনিধি দলে যতজনই যাক না কেন সম্পূর্ণ ব্যয় শিক্ষামন্ত্রী নিজস্ব ভাবে বহন করবেন। তোমাদের সাথে আলোচনায় বসে সমস্যার সমাধান করতে চান শিক্ষামন্ত্রী। তোমরা তোমাদের সিদ্ধান্ত আমাদের জানাও, আমি তা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিব।'

 

এদিকে বুধবার (১৯ জানুয়ারি) বেলা ৩টা থেকে অনশন শুরু করেন ২৪ জন শিক্ষার্থীরা। পরে বৃহস্পতিবার দুপুরে ১ জন পারিবারিক সমস্যার কারণে বাড়িতে চলে যান।