ঢাকা, শুক্রবার ৩ মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১

সিলেটি মা: অনেক সাহসী আমার মা

এমএ রহিম, সিলেট : | প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ১২:৪৯:০০ অপরাহ্ন | সিলেট প্রতিদিন

’মায়ের মুখে মুক্তিযদ্ধের গল্প শুনেছি। ওই সময় আমি পৃথীবির আলো দেখিনি। ১৯৭৩ সালে আমার জন্ম। বুঝতে শেখার পর মা প্রায় সময় মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতেন। নানান আবদুল ওয়াহিদ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। যার জন্যে স্থানীয় রাজাকার আর পাকিস্তানি হায়েনাদের রোষাণলে পড়তে হয়েছিল আমাদের পুরো পরিবারকে। বাড়িঘর ছেড়ে শরনার্থী হয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আশ্রয় নিতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের অধিকাংশ সময় রিফিউজি আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে অবস্থান করতে হয়েছে। দিনের পর দিন অনাহারে দিন কাটাতে হয়েছে। আমার বড় ভাই বোনেরা সে সময় অনেক ছোট ছিল। যুদ্ধের মাঠে তাদেরকে সামাল দেয়া ছিল আরো কষ্টসাধ্য ব্যাপার। মা সাহসী হয়ে উঠেন। ভাই বোনদের বাঁচিয়ে রাখতে অবিরাম নিজের সাথে যুদ্ধ করেছেন। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন অনেক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরিবারের সকল সদস্য বাড়ি ফেরেন।’

মায়ের সাহসী হয়ে উঠার গল্প ওইভাবে দৈনিক বায়ান্নের কাছে তুলে ধরেন সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলার সাদিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেদ আহমেদ ভিপি মুছা।
 
ভিপি মুছা বলেন, ভাই বোন, পরিবার, আত্মীয়স্বজনসহ পাড়া প্রতিবেশিকে সামাল দেয়া মা মুক্তিযুদ্ধে শিক্ষা পেয়েছিলেন রাজনীতির। একজন সাধারণ গৃহীনি থেকে হয়ে উঠেন রাজনৈতিক সচেতন এক নারী। ভাই বোনদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন ভিপি মুছা। ভিপি মুছাকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনীতিক কর্মী হিসেবে গড়ে তোলার তালিম দিতে থাকেন শৈশব থেকেই। মায়ের বাধ্য সন্তান ভিপি মুছাও স্কুল গন্ডি পার হওয়ার আগেই ছাত্রলীগের রাজনীতি চর্চা শুরু করেন।

সাদিপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন ভিপি মুছা। সাদিপুর ইউনিয়নের সরৎ সুন্দরী হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর ভর্তি হন তাজপুর ডিগ্রি কলেজে। কলেজের সংসদ নির্বচনে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে নির্বাচিত হন ভিপি। ছাত্র রাজনীতি করার সময় পরিচ্ছন্নভাবে মা সমর্থন দিয়ে গেছেন। বাড়িতে দলের নেতাকর্মীদের আনাগোনা ছিল সব সময়। মা তাদেরকে আপ্যায়ন করার সব ধরণের ব্যবস্থা করতেন। মা এখন বসবাস করেন যুক্তরাজ্য। সেখান থেকেই তিনি খবর রাখেন। প্রয়োজনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। যুক্তরাজ্য থেকে বাড়িতে এলে মায়ের আশপাশ ঘিরে পাড়া প্রতিবেশিসহ আত্মীয়স্বজনের ভীড় লেগে যায়। ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ।
সাহেদ আহমেদ ভিপি মুছার বাড়ি সাদিপুর ইউনিয়নের গজিয়া গ্রামে। পিতা আলাউদ্দিন আহমদ ২০০৮ সালে যুক্তরাজ্যে মৃত্যুবরণ করেন। দেশে অবস্থানকালে তিনি ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। মা রেজিয়া খানমের বয়স ৮৪ অতিক্রম করেছেন। বসবাস করছেন যুক্তরাজ্যে। বড় বোন আফরোজা বেগম স্বামী সন্তান নিয়ে বসবাস করেন কানাডায়। ভাই মোহাম্মদ শাহজাহান বসবাস করেন যুক্তরাজ্যে। ভাই আলী আহমদ মতিন দেশে ব্যবসা করেন। বোন ফাতেহা ইয়াসমিন আহমদ স্বামী সন্তান নিয়ে বসবাস করেন যুক্তরাষ্ট্রে। ভাই ফরিদ আহমদ মাহিন বসবাস করেন যুক্তরাজ্যে। ভিপি মুছাও কিছুদিন যুক্তরাজ্যে ছিলেন। মাটির টানে দেশে এসে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত রয়েছেন।


ভিপি মুছা বলেন, ২০০৩ সালে মা পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। বাড়িতে থাকা আমাদের বিশাল পরিবার মা একাই সামাল দিয়েছেন। যৌথ পরিবারে মা ছিলেন সবার বড়। স্বাভাবিক নিয়মে সকল দায় দায়িত্ব একাই মা পালন করেছেন। আত্মীস্বজন পাড়া প্রতিবেশিরা সার্বক্ষণিক আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করতেন। আত্মীয় স্বজনের সকল ধরণের চাহিদা পূরণে মা থাকতেন সতর্ক। প্রয়োজন মেটাতেন প্রতিবেশির। ধান কাটার সময় এলে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ত। সাত সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মায়ের পদচারণা থাতক পুরো বাড়ি জুড়ে। এখনো যুক্তরাজ্য থেকে বাড়িতে এলে মায়ের তদারিক চলে সর্বত্র।


ভিপি মুছা বলেন, বাবা যুক্তরাজ্য থাকায় আমরা ভাই বোনের লেখাপড়াসহ সকল ধরণের দায়িত্ব মা একাই পালন করতেন। বাবার ভূমিকাও তিনি পালন করতেন। আমরা ভাই বোনের লেখার পড়ার প্রয়োজনে সিলেট শহরে পুরো পরিবার চলে আসি। কুয়ারপাড়ে বাসা নেয়া হয়। এই বাসায় অবস্থান করার পর ভিপি মুছার লেখা পড়া শুরু হয়। সবাইকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। ভিপি মুছা ভর্তি হয়েছিলেন মির্জাজাঙ্গাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
তিনি বলেন, মায়ের কাছে প্রথমে আরবি শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল। মা আরবি অক্ষর শিখিয়েছিলেন। সাতসকালে ঘুম থেকে জেগে উঠতেন মা। ফজর নামাজ পড়ে আমরা ভাই বোনকে ডেকে তুলতেন। নাস্তা তৈরি করতেন মা। নাস্তা শেষে বাংলা পড়তেন বসতেন সবাই। স্কুলে সময় হতেই সকলকে প্রস্তুত করে স্কুলে পাঠাতেন। স্কুলে যাওয়ার সময় উপদেশ দিতেন। কারো সাথে ঝগড়া করা যাবে না। সবার সাথে আচরণ করতে হবে ভালো। মায়ের উপদেশ আমরা ভাই বোনেরা মেনে চলতাম। স্কুল ছুটি শেষে বাসায় ফিরে দেখতাম মা অপেক্ষা করছেন। খাবার শেষে বিশ্রামে যেতাম। বিকেলে আরবি শিক্ষক আসতেন। আমরা ভাই বোনেরা আরবি পড়া শেষ করতাম সন্ধ্যার আগে। আরবি শেখার সময় নামাজ পড়া শিখিয়েছেন গৃহশিক্ষক। বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করেছেন মা। সান্ধ্যকালীন নাস্তা শেষে বাংলা পড়তে বসতেন। রাত ৮ টার মধ্যে বাংলা পড়া শেষে টিভি কক্ষে গিয়ে বসতাম। সেসময় স্যাটেলাইট ছিল না। বিটিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখে রাত ১০ টা বেজে যেত। রাতের খাবার শেষে ঘুমাতে যেতাম। আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মা যেতেন বিশ্রামে। এর আগে পরখ করে দেখতেন আমরা ঘুমিয়েছি কি না। ৯ম শ্রেণিতে উঠার পর ভিপি মুছাসহ পুরো পরিবার আবার ফিরে আসেন গ্রামের বাড়িতে। সেখানে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হন ভিপি মুছা।


ভিপি মুছা বলেন, মা থাকেন যুক্তরাজ্যে। প্রতিনিয়ত ফোন করেন। খবর নেন খাবার দাবারের। শরীরের প্রতি যতœ নেয়ার জন্যে বলেন। অসহায় মানুষের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্যে বলেন। মায়ের আদেশের মধ্যে থাকে আমার সব সুখ আর শান্তি।