ঢাকা, রবিবার ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১

হরতালের অজুহাতে বাজাররে আগুন

নিজস্ব প্রতিবেদক: | প্রকাশের সময় : সোমবার ৩০ অক্টোবর ২০২৩ ১১:৫৮:০০ পূর্বাহ্ন | অর্থনীতি ও বাণিজ্য

রাজনৈতিক অস্থিরতা আর হরতালের অজুহাতে আবারও অশান্ত হয়ে উঠেছে নিত্যপণ্যের বাজার। গত শুক্র ও শনিবারের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আর রবিবার হরতালের অজুহাতে এবার আরেকদফা নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পণ্যমূল্যবৃদ্ধির জন্য কখনও পণ্য সংকট, আবার কখনও পরিবহন সংকটকে দায়ী করে থাকেন। আবার আমদানি নির্ভর পণ্য না হলেও মূল্যবৃদ্ধির জন্য কখনও ডলার সংকটকেও দায়ী করা হয়। এবার পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য হরতালকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ী, বলছেন রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

 

রবিবার (৩০ অক্টোবর) রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে দেখা গেছে, প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা দরে। ক্রেতারা দাম নিয়ে মুলোমুলি করতে গেলে খুচরা বিক্রেতারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছেন, দাম আরও বাড়তে পারে। কোনও কারণ ছাড়াই বেড়েছে চাল ও পেঁয়াজের দামও। অস্থির করা ডিমের দাম এখনও আগের দামেই। যা অনেক আগেই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরে চলে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে চাল, আলু, ডিম ও পেঁয়াজের দাম ঠিক করে দিলেও তা কার্যকর করা যায়নি একদিনের জন্যও।

 

 

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মোটা জাতের বিআর ২৮ চালের দাম বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে; যা ৫২-৫৩ টাকা ছিল। সরু চাল মিনিকেট ও নাজিরশাইল ৭২-৭৫ টাকা আবার প্রকার ভেদে তা ৮০ থেকে ৮৬ টাকা কেজিদরে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে প্রতিকেজি দেশি বাছাই করা পেঁয়াজের দাম উঠেছে ১৩০ টাকা পর্যন্ত; যা গত সপ্তাহের থেকে কেজিপ্রতি ৩০-৪০ টাকা বেশি। আমদানি করা ভারতের পেঁয়াজ ১১০-১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। যদিও সরকারের বেঁধে দেওয়া পেঁয়াজের দর ছিল প্রতি কেজি ৬৫ টাকা। বাজারে আলুর দাম উঠেছে কেজিপ্রতি ৬০ টাকায়। যা গত সপ্তাহের তুলনায় ১০ টাকা বেশি। আর সরকার নির্ধারিত আলুর দাম প্রতি কেজি ৩৬ টাকা।

 

 

একইভাবে বাজারে ব্রয়লার মুরগি ২০০-২১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। নতুন করে এসব পণ্যের দাম এমন সময় বেড়েছে যখন বাজারে প্রায় সব ধরনের শাক সবজি ও মাছের দাম আগে থেকেই বেড়ে রয়েছে। 

 

উল্লেখ্য, গত ১৪ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের দাম নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি তিন কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত জানান। সে অনুযায়ী প্রতি কেজি পেঁয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য হবে ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা। আলু কেজিতে ভোক্তা পর্যায়ে ৩৫-৩৬ টাকা এবং কোল্ড স্টোরেজ থেকে ২৬-২৭ টাকা কেজি দরে বিক্রির সিদ্ধান্ত দেয়। ডিমের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য প্রতি পিস ১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরপরও দাম নিয়ন্ত্রণে না এলে ডিম আমদানির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। ডিমের দাম সরকারের সিদ্ধান্ত মতো না আসার কারণে সরকার ১০ কোটি পিস ডিম আমদানির অনুমতিও দেওয়া হয়েছে।

 

 

নিত্যপণ্যের এই মুল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, হরতালের কারণে বাজার খারাপ। কেনা-বেচা হচ্ছে না সেভাবে। যেটুকু হচ্ছে তা খুবই কম। কারণ বাজারে পণ্যের সংকট রয়েছে। হরতালে বাজারে পণ্য আসতে পারছে না। পরিবহন সংকট। তার উপর ভাড়া বেশি। এসব কারণেই মূলত পণ্যের দাম বেশি বেড়েছে। 

 

তারা আরও জানান, যে সব নিত্যপণ্য দেশে উৎপাদিত হয় সেসব পণ্য উৎপাদনে কোনও না কোনও পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। সে ক্ষেত্রে রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধ সেসব পণ্য আমদানিতে বাধার সৃষ্টি করছে। এর উপরে রয়েছে ডলার সংকট। চাহিদা থাকলেও ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না। কারণ ব্যাংকে রয়েছে ডলার সংকট। বাইরে থেকে ডলার কিনতে গেলে সেখানে রয়েছে বাড়তি দাম। ৮২ টাকার ডলার এখন কিনতে হচ্ছে ১২০ টাকা দরে। ডলারের এই যে বাড়তি দাম তা গিয়ে পড়ছে পণ্যের উপরে। এসব কারণে কোনোভাবেই সরকার নির্ধারিত দরে পণ্য বিক্রি করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন তারা।

 

অপর দিকে সরকারের পক্ষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, আমরা সব কিছুই বিবেচনায় নিয়ে ডিম আলু ও পেঁয়াজের দাম ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। এখন ব্যবসায়ীদের এই অভিযোগ ঠিক না। তারা অনেতিক মুনাফা করছে। এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর কাজ করছে। 

 

অপরদিকে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, আমরা আলু, পেঁয়াজ ও সবজির বাজার নিয়ন্ত্রণ অনেক সময় করতে পারছি না। মূল্য নির্ধারণ করেও তা বাস্তবায়ন করতে পারছি না। এটা আমাদের দুর্বল দিক। কোল্ড স্টোরেজের মালিকরা আমাদের সহযোগিতা করছে না। মাঠ পর্যায়ে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা তদারকি করতে গেলে তারা কোল্ড স্টোরেজ বন্ধ করে দেয়, সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। 

 

কৃষিমন্ত্রী বলেন, প্রচুর পরিমাণ উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও আমরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। কারণ পেঁয়াজ দ্রুত পচনশীল কৃষিপণ্য, সংরক্ষণ করা যায় না। দেশে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ টন সবজি উৎপাদন হয়। ২০০৯ সালে সবজির উৎপাদন ছিল মাত্র ৩০ লাখ টন। গত ১৫ বছরে সবজির উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৭ গুণ। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় সবজির দাম বাড়ছে। আলুও দ্রুত পচনশীল একটি কৃষিপণ্য। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ী ও কোল্ড স্টোরেজের মালিকরা বাড়তি দামে বিক্রি করছে। 

 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাওরানবাজারের ব্যবসায়ী মো. হেমায়েত হোসেন জানিয়েছেন, সরকার নির্ধারিত দরে পণ্য বিক্রি করলে আমাদের ব্যবসা টিকবে না। বিভিন্ন কারণে পরিবহন খরচ বেড়েছে, লেবার কস্ট বেড়েছে। আমদানি নির্ভর পণ্যের জটিলতা তো অনেক আগে থেকেই। কাজেই আমাদের চাপ দিয়ে লাভ নাই। বেশি চাপ দিলে ব্যবসা গুটিয়ে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নাই। কারণ লস দিয়ে তো ব্যবসা করা যাবে না।