ফাঁস হওয়া পেন্টাগনের গোপন প্রতিবেদনে পরিষ্কার বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর গোয়েন্দা নজরদারি করছে। প্রতিবেদনে ইউক্রেন যুদ্ধ ছাড়াও চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কয়েকটি মিত্র দেশের প্রসঙ্গও রয়েছে।
প্রতিবেদনটি ফাঁস হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে সম্পর্ক চাপে পড়তে পারে। দক্ষিণ কোরিয়া বলছে ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনের বিষয়গুলো তারা তদন্ত করছে। কিন্তু একইসাথে সিউল জোর দিয়ে বলছে, প্রেসিডেন্টের অফিসের ভেতর হওয়া ব্যক্তিগত আলাপে আড়িপাতা অসম্ভব।
কীভাবে এবং কোন সূত্রে পেন্টাগনের এই গোপন প্রতিবেদন ফাঁস হলো মার্কিন সরকার তা এখন তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। পেন্টাগন বলছে, এই ফাঁসের ঘটনা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি।
বিবিসির দেখা এই নথি পড়ে মনে হয়েছে, ইউক্রেন ব্যবহার করতে পারে এমন অস্ত্র-গোলাবারুদ বিক্রি করা নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার নীতি-নির্ধারকরা বড় ধরনের দোটানায় পড়েছেন।
ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়াকে চাপ দিয়ে চলেছে, কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া এখনও তা শোনেনি। যুক্তি হিসাবে তারা বলছে, যুদ্ধে লিপ্ত কোনও দেশে অস্ত্র পাঠানো তাদের জাতীয় নীতির পরিপন্থী।
গত বছর দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কামানের গোলা বিক্রি করতে সম্মত হয় কারণ ইউক্রেনকে দিতে গিয়ে আমেরিকার নিজের মজুদে টান পড়েছে।
তবে দক্ষিণ কোরিয়া শর্ত দিয়েছে তাদের কাছ থেকে পাওয়া গোলাবারুদ যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে দিতে পারবে না।
ফাঁস হওয়া গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, দক্ষিণ কোরিয়া এই অস্ত্র বিক্রি চুক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ তারা আশংকা করছে যুক্তরাষ্ট্র এসব গোলা নিশ্চিতভাবে ইউক্রেনে পাঠাবে।
এই উদ্বেগ নিয়ে গত ১ মার্চে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের দু’জন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মধ্যে কথোপকথন ফাঁস হওয়া ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক ইওলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সচিব জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কিম সুং হানকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই এসব অস্ত্র শেষ পর্যন্ত থাকবে কি না তা নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন।
কথোপকথন থেকে বোঝা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তারা এমন উদ্বেগেও রয়েছেন যে প্রেসিডেন্ট বাইডেন হয়তো প্রেসিডেন্ট ইয়ুনকে সরাসরি ফোন করে ইউক্রেনকে অস্ত্র দিতে অনুরোধ করবেন। দক্ষিণ কোরিয়াকে যদি তা মানতে হয় তাহলে মানুষের কাছে এমন বার্তা যাবে যে আমেরিকার চাপে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার তাদের নীতি বদলে ফেলতে বাধ্য হয়েছে।
মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি এমন সময় ফাঁস হলো যখন প্রেসিডেন্ট ইয়ুন আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাবেন।
তবে মার্কিন সরকার একথা গোপন রাখেনি যে তারা চায় দক্ষিণ কোরিয়া ইউক্রেনকে অস্ত্র দিক। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে দক্ষিণ কোরিয়া যে দ্রুতগতিতে অত্যাধুনিক অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা রাখে তাতে তারা ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
• রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক নিয়ে ভীতি
তবে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক চটে যাওয়ার ভয়ে ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়ার ব্যাপারে দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে অনীহা রয়েছে।
‘দক্ষিণ কোরিয়া কয়েকটি দেশের সাথে সম্পর্কে সবসময় স্পর্শকাতর একটি ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন ,’ বিবিসিকে বলেন জেনি টাউন যিনি গবেষণা সংস্থা ট্যাংক থার্টি-এইট নর্থের কোরিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক।
গোপন এই প্রতিবেদন ফাঁস হওয়ার সময়টি খুবই স্পর্শকাতর। কারণ দুই দেশের মধ্যে মৈত্রীর ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট ইয়ুন দুই সপ্তাহ পর যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন।
গোয়েন্দা রিপোর্টে দক্ষিণ কোরিয়া সংশ্লিষ্ট অংশগুলো বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশ হওয়ার পর সোলের সরকারের বড়রকম বিড়ম্বনায় পড়েছে। কারণ বিরোধী দল প্রশ্ন তুলেছে, এমন গোপন শলা-পরামর্শ কীভাবে আমেরিকানরা শুনলো।
সোমবার এক বিবৃতিতে বিরোধী দল বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে এবং সেইসাথে সরকার জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
তবে প্রেসিডেন্ট ইয়ুনের সরকার এই ফাঁসের ঘটনা নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করছে না। তারা বলছে, গোয়েন্দা প্রতিবেদনে যেসব কথা বলা হয়েছে তার অনেকটাই অতিরঞ্জিত, সত্যি নয়। সরকারি একটি সূত্র বলেছে, শীর্ষ বৈঠকের আগে ঘটনাকে এমনভাবে অতিরঞ্জিত করে দেখিয়ে সম্পর্ক নষ্ট করার চেষ্টা নস্যাৎ করা হবে। বিবিসি বাংলা।