দক্ষিণ আফ্রিকায় আগামী আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত হবে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা- এই পাঁচ দেশকে নিয়ে গঠিত জোট ব্রিকস-এর সম্মেলন। রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিধর এই দেশগুলোর রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপথকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করার সক্ষমতা।
ভূরাজনৈতিক ইস্যুর পাশাপাশি সম্মেলনে গুরুত্ব পাবে ব্রিকসভুক্ত রাষ্ট্র এবং এই জোটের সহযোগী দেশগুলোর মধ্যকার অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়টি।
এ ধারাবাহিকতায় সম্মেলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্যসূচি হতে যাচ্ছে আর্থিক লেনদেনের জন্য ব্রিকস-এর তরফে একটি অভিন্ন প্লাটফর্ম বা পেমেন্ট সিস্টেম স্থাপনের বিষয়টি।
এরইমধ্যে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ব্রিকসের অন্যতম সদস্যরাষ্ট্র রাশিয়া। রুশ সংবাদমাধ্যম আরটি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
কেন বিকল্প মুদ্রা
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে আরটির প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন ডলারের বিপরীতে মুদ্রার দরের ওঠানামায় লেনদেনে সমস্যা পোহাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। আবার বিভিন্ন দেশের নিজস্ব মুদ্রায় পারস্পরিক বাণিজ্যিক লেনদেনের বিষয়টিও জটিল। তবে নতুন ব্রিকস মুদ্রা এই সমস্যার একটি টেকসই সমাধান হতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
এ বিষয়ে এক বিবৃতিতে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বাস্তবতায় জোটের নেতাদের আসন্ন বৈঠকে এই ইস্যুতে আলোচনা হবে।
আরটির ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নিজেদের আন্তঃবাণিজ্যিক লেনদেনে ডলারের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো আগ্রহী। আর এই কার্যক্রম আরও গতি লাভ করে যখন অবরোধ আরোপের মাধ্যমে পশ্চিমা আর্থিক ব্যবস্থা থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।
ডলারের বিকল্প নিয়ে কাজ চলছে
ব্রিকসের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ছাড়াও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উন্নয়নশীল দেশ এরইমধ্যে ডলারের বিকল্প মুদ্রায় বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করেছে।
আরটির প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র-চীন বিরোধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ঋণসীমা বৃদ্ধি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত ডলারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। ফলে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুদ্রা হিসেবে ডলার নিজের অবস্থান কতটা ধরে রাখতে পারবে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ডলার বাদ দিয়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে স্থানীয় মুদ্রার ব্যবহার বাড়াতে এরইমধ্যে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বেশ কিছু দেশ। মূলত ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই এই প্রবণতা আরও বেড়ে যায়।
পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে বাণিজ্যে ডলারের বিকল্প হিসেবে স্থানীয় মুদ্রা রুবল ও চীনা মুদ্রা ইউয়ানে লেনদেন বেড়েছে। বিশ্ববাজারে ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে চীন, ভারতসহ অনেক দেশই স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিরহাম ও রাশিয়ার মুদ্রা রুবলে। চীন নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ানে ৮৮ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের তেল, কয়লা ও ধাতু কিনেছে রাশিয়া থেকে। পাশাপাশি চীনের জাতীয় তেল কোম্পানি সিএনওওসি এবং ফ্রান্সের টোটালএনার্জি গত মার্চে প্রথমবারের মতো তাদের তরল প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি কেনাবেচার বাণিজ্য করেছে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে।
এ অবস্থায় পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। এরইমধ্যে ভারতের সঙ্গে বৈশ্বিক বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের পাশাপাশি রুপি ব্যবহার শুরু করেছে বাংলাদেশ।
গত বছর ব্রিকস-এর নিজস্ব মুদ্রার ধারণাটি প্রথম উপস্থাপন করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন । এরই ধারাবাহিকতায় গত জুন মাসে রুশ প্রেসিডেন্ট জানান, ব্রিকসের সদস্য রাষ্ট্রগুলো জোটের নিজস্ব রিজার্ভ মুদ্রা তৈরির বিষয়ে কাজ করছে।
ব্রিকসে যোগ দিতে পারে বাংলাদেশও
বিশ্ব যখন নতুন মুদ্রাযুগের দ্বারপ্রান্তে, তখন ২২ থেকে ২৪ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠেয় ব্রিকসের পঞ্চদশ সম্মেলনে জোটের সদস্যভুক্ত দেশগুলো ছাড়াও বাংলাদেশসহ ৭০টি দেশের সরকারপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
আয়োজক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা গত ১৪ জুন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তাকে ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান।
সে সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ শিগগিরই ব্রিকসের সদস্যপদ লাভ করতে পারে। ভবিষ্যতে আরও আটটি দেশ সদস্য পদ পেতে পারে। এর মধ্যে বাংলাদেশ, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইন্দোনেশিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এরমধ্যেই ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্য হয়েছে। ২০২১ সালে এই সদস্যপদ লাভ করে ঢাকা।
ব্রিকস মুদ্রা কি বাস্তব হবে
ব্রিকস মুদ্রার আলোচনা এরইমধ্যে বেশ গতি পেয়েছে, তবে বিবেচনাধীন বিভিন্ন মডেলের এখনও পর্যন্ত তেমন কোনো তথ্য নেই। ইউরোর মতো একটি ব্রিকস সংস্করণ আপাতত সম্ভব নয়, বলছেন বিশ্লেষকরা। আর জড়িত দেশগুলোর কেউই তাদের স্থানীয় মুদ্রা বন্ধ করে দেবে এমনও নয়।
এ অবস্থায় প্রথম ধাপ হিসেবে আন্তঃসীমান্ত লেনদেনের জন্য একটি দক্ষ সমন্বিত অর্থ আদান-প্রদানের ব্যবস্থা তৈরির কথা বলা হচ্ছে। এরপর হয়তো একটি নতুন মুদ্রা প্রবর্তন হতে পারে।
দ্বিপাক্ষিক ‘ডি-ডলারাইজেশন’ চেষ্টায়ও একই ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রাশিয়া এবং ভারত স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনের জন্য একটি প্রক্রিয়া তৈরি করেছে, যা ভারতীয় আমদানিকারকদের রাশিয়ার সস্তা তেল এবং কয়লার জন্য রুপিতে পরিশোধ করতে সহায়তা করবে। তবে রুপি জমার ধারণায় মস্কো ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার পর আলোচনা স্থগিত করা হয়।
এদিকে ডি-ডলারাইজেশনে বাধা থাকার পরেও, ব্রিকস গ্রুপের কাজ করার সংকল্পকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায়না। কারণ এই গ্রুপটির অতীতে প্রত্যাশার বিরুদ্ধে সাফল্য পাওয়ার রেকর্ড আছে। তাই ব্রিকস জোটের আগামী সম্মেলন ঘিরে আগ্রহ বাড়ছে সবার।