দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে পৃথিবীর বুকে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। হাজার বছরের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয় বাঙালি। তবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সৃষ্টি হয় এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।
একদিকে দীর্ঘদিনের শোষণে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের অর্থনীতি আগেই ভঙ্গুর করে রেখেছিল। অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও খরাজনিত কারণেও পিছিয়ে ছিল দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা। ফলে যুদ্ধের সময় ধ্বংস হওয়া দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে হিমশিম খেতে হয় নতুন সরকারকে।
এসব দেখে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে অভিহিত করেছিলেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে। তবে বিশ্লেষকদের অনুমান সত্য হয়নি। কিসিঞ্জারদের অভিশাপ বিফলে গেছে।
বিশ্ব আজ দেখছে, সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর বদলে যাওয়া এক বাংলাদেশ। মেধা আর পরিশ্রমে বাংলাদেশের অর্থনীতি দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয় ১৯৭২ সালে। সে সময়ে অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে এগিয়েছিল। এখন অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিটি সূচকেই ঈর্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশের। আজ ৫০ বছর পর আর্থ-সামাজিক বেশিরভাগ সূচকেই বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে আছে পাকিস্তান।
বিশ্ব নেতাদের কারো কারো মতে, বাংলাদেশ এখন ‘উন্নয়নের রোল মডেল‘; কেউ বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার ‘তেজি ষাঁড়’; কারো মতে, অফুরন্ত সম্ভাবনার এক দেশ। এমনকি বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন খোদ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও।
ঠিক কতটা এগিয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তানকেই বা কতটা পেছনে ফেলেছে কিছু তুলনামূলক পরিসংখ্যান দেখলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১২০ মার্কিন ডলার আর পাকিস্তানের ছিল ১৮০ ডলার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে দেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। সেখানে সংবাদ সংস্থা এএনআই-এর তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ৫৪৩ ডলার।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। পাকিস্তানের জিডিপির প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ রফতানি করেছে ৩ হাজার ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য। সেখানে পাকিস্তানে রফতানি আয় ২ হাজার ৫৩০ কোটি ডলার।
১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার এবং পাকিস্তানের রফতানির পরিমাণ ছিল ৭৬ কোটি ডলার। ৫০ বছর আগে বাংলাদেশের রফতানি ছিল পাকিস্তানের অর্ধেকেরও কম। আর এখন পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে তাদের চেয়ে দেড় গুণেরও বেশি রফতানি করছে বাংলাদেশ। তৈরি পোশাক রফতানিতে মহা শক্তিধর চীনের পরই বাংলাদেশ, বিশ্বে অবস্থান দ্বিতীয়।
বাংলাদেশের মুদ্রার মানও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি, ১৯৭২ সালে যা বেশ কম ছিল। বর্তমানে ১ মার্কিন ডলারের সমান বাংলাদেশের ৮৬ টাকা আর পাকিস্তানের ১৭৮ রুপি।
২০২১ সালের নভেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলার, আর পাকিস্তানের ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ, পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের রিজার্ভ প্রায় দ্বিগুণ।
১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছর, পাকিস্তানের ছিল ৫৪ বছর। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছর, পাকিস্তানের ৬৭ বছর।
পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার বাংলাদেশে হাজারে ২৫ জন, যেখানে পাকিস্তানে প্রতি হাজারে মারা যায় ৫৯ জন। বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাপর্ব শেষ করছে ৯৮ শতাংশ শিশু, পাকিস্তানে ৭২ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের ‘দ্য হিউম্যান ক্যাপিটাল ইনডেক্স ২০২০ আপডেট : মানবপুঁজি সূচকে ১৭৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩তম। সেখানে পাকিস্তানের অবস্থান অনেক পেছনে, ১৪৪তম।
এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান, অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন দক্ষিণ এশিয়ায় একটি দরিদ্র দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। এখন এটি পুরোপুরি উল্টো হয়ে গেছে। দেশ স্বাধীনের সময় মাথাপিছু আয়ে পাকিস্তান আমাদের চেয়ে এগিয়ে ছিল। এখন পাকিস্তানকে আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। আমরা ভারতের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। অর্থনৈতিক অনেক সূচকে আমরা এগিয়ে আছি। বর্তমান আর্থসামাজিক বেশিরভাগ সূচকে অবশ্যই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এখন আমাদের অবস্থান অনেক ভালো। আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের সম্মান এখন উচ্চতর অবস্থানে।
ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনোমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের সবশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন বলে দিচ্ছে দেশটি বৃহৎ অর্থনীতির দেশের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে।