ঢাকা, রবিবার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

এক যুদ্ধেই টালমাটাল গোটা বিশ্ব

Author Dainik Bayanno | প্রকাশের সময় : শনিবার ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:০৩:০০ অপরাহ্ন | আন্তর্জাতিক

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।

 

আঞ্চলিক রাজনীতি ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এ যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে।

 

   

এ যুদ্ধে হাজারো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, কোটি মানুষ ঘর ছেড়েছে। ক্ষয়ক্ষতির হিসাবও কম নয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ঘিরে নিষেধাজ্ঞা পাল্টা নিষেধাজ্ঞার খেলায় নাজুক হয়ে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই এ যুদ্ধের প্রভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে এ যুদ্ধ বহুমুখী সংকট তৈরি করেছে।  

যুদ্ধের সার
২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন টেলিভিশনে এক ভাষণে ঘোষণা দেন যে, তিনি ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান চালাবেন নাৎসিমুক্তকরণ ও নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে। এরপরই ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া।  

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও শপথ নেন, তার দেশ যুদ্ধ করবে। তার সরকার সামরিক আইন জারি করে এবং ইউক্রেনবাসীদের অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার আহ্বান জানায়।  

যুদ্ধের প্রথম মাসে রুশ বাহিনী রাজধানী কিয়েভ, দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভসহ বড় শহরগুলোর দিকে চাপতে থাকে। মস্কোবাহিনী খেরসনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তবে পরে ইউক্রেনের কঠিন প্রতিরোধের মুখে পড়ে।  কিয়েভের দিকে রুশ বাহিনীর এগিয়ে যাওয়ার পরিণতি হিসেবে উপকণ্ঠ বুচা হয়ে ওঠে এক ট্র্যাজেডি। মার্চের শেষ দিকে কিয়েভ অঞ্চল থেকে রাশিয়া সৈন্যদের সরিয়ে নিলে নতুন করে চোখ পড়ে দনবাস অঞ্চলের ওপর। এ সময় রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তোলে ইউক্রেন।

এপ্রিলে বুচা শহর পরিদর্শনে গিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর করিম খান ইউক্রেনকে ‘অপরাধ পট’ হিসেবে বর্ণনা করেন।  

জুনে রাশিয়া ইউক্রেনের এক পঞ্চমাংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। ভয়াবহ লড়াই শেষে দক্ষিণের বন্দর শহর মারিওপোলও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় রাশিয়া। ইউক্রেনের পক্ষ থেকেও পাল্টা প্রতিরোধ আসতে থাকে।

এক পর্যায়ে সেপ্টেম্বরের শেষে পুতিন ইউক্রেনে অধিকৃত চারটি এলাকাকে রুশ ফেডারেশনের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেন। চারটি এলাকা হলো খেরসন, জাপোরিঝিয়া, দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক। এই চার অঞ্চলে পুতিন গণভোটেরও আয়োজন করেন। তবে এই ভোটের ফলকে কিয়েভ ও এর পশ্চিমা মিত্ররা অবৈধ-অর্থহীন বলে উড়িয়ে দেয়।  

বছরের শেষে এসে রাশিয়া ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্রের ঢল বইয়ে দেয়। ২৯ ডিসেম্বর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাডভাইজার মিখাইলো পোডোলিয়াকের বরাতে বিবিসি জানায়, রাশিয়া ১২০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। কিয়েভসহ খারকিভ, ওদেসা, লিভিভ ও জাইতোমির শহরে এসব ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়।  

ঘরছাড়া কোটি মানুষ
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের কোটি মানুষ হয়েছে ঘরছাড়া। তাদের অনেকেই আশপাশের দেশে আশ্রয় নিয়েছে। আলজাজিরা এক প্রতিবেদনে বলেছে, এই যুদ্ধে ৪০ মিলিয়ন বা চার কোটি মানুষ ঘর ছেড়েছে। ৭ দশমিক ৮ মিলিয়ন শরণার্থী ইউরোপের দিকে গিয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৬ মিলিয়ন মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর ২৭- সদস্য রাষ্ট্রে ইউক্রেনীয়দের সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত কাজ এবং অবস্থানের অনুমোদন দিয়েছে।   

ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে জাতিসংঘের হিসাবে ১৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন মানুষ সীমান্ত দিয়ে ইউক্রেন ছেড়েছে, প্রবেশ করেছে ৮ দশমিক ৭ মিলিয়ন মানুষ। যারা পালিয়ে গেছে, তাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের থেকে যুদ্ধ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।  

বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান এ দ্বন্দ্ব বিশ্বে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। খাদ্যপণ্য সার ও জ্বালানির দাম নাগালছাড়া হয়েছে।  
এই যুদ্ধ রাশিয়ার জ্বালানির ওপর ইউরোপের নির্ভরতার বিষয়টি সামনে এনেছে। শস্য পরিবহনের ক্ষেত্রে নানা সংকটের কারণে খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হয়েছে। ফলে ইউক্রেন ও রাশিয়ার শস্যের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোতে খাদ্যের দাম বেড়েছে।   রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে। শ্রমশক্তির স্থানচ্যুতি থেকে শুরু করে বাজারে প্রবেশাধিকার সীমিত হয়েছে।

আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে ইউক্রেনের জিডিপি এক তৃতীয়াংশ কমে যাবে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ইউক্রেনে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ১০ শতাংশ। ২০২২ সালের নভেম্বরে তা দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশে। রুটির মতো খাদ্যের দাম বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। জ্বালানি ও পরিবহন খরচ বেড়েছে অন্তত ৪০ শতাংশ।  

অন্ধকারে জীবন
অক্টোবরের ১০ তারিখ থেকে রাশিয়ার একের পর এক হামলায় ইউক্রেনে বিদ্যুৎ অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে। কয়েক মিলিয়ন মানুষ অন্ধকারে দিনযাপন করছে। কঠিন পরিবেশগত পরিস্থিতি এড়াতে বেগ পেতে হচ্ছে তাদের।  

রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের ৪০ শতাংশেরও বেশি জ্বালানি সুবিধা ধ্বংস হয়েছে। অনেক শহরে লোকজন পানি না পেয়ে এবং শীতে দুর্ভোগে পড়েছে। ইউক্রেনের পশ্চিমা বন্ধুরা বলছে, ইউরোপে শীতকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অবকাঠামোগুলোর ওপর হামলা চালানো হয়েছে।  
ফেব্রুয়ারির পর থেকেই ইউক্রেনে শক্তি উৎপাদন কমতে শুরু করে। দেশটিতে ১৫টি নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর বিদ্যুৎ গ্রিড থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।
শীত চলে আসায় দেশটিতে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম থাকায় লোকজন বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। তারা স্লিপিং ব্যাগ ব্যবহার করে নিজেদের গরম রাখছে। ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে। লোকজন ফোন চার্জ দেওয়ার স্থান খুঁজে বেড়াচ্ছে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা
ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে কমপক্ষে ৪৬টি দেশ রাশিয়ার ওপর ১০ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি নিষেধাজ্ঞা পেয়ে ইরান, সিরিয়া ও উত্তর কোরিয়াকে পেছনে ফেলেছে রাশিয়া।  অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, জাপান, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৮ হাজার ৬১৩টি একক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ ছাড়া এক হাজার ৬৫৮টি সংস্থা, ৯২টি নৌযান ও ১৪টি এয়ারক্র্যাফটের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশগুলো।  ২০২২ সালের শেষে রাশিয়ার জিডিপি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।  

ইউক্রেনে পশ্চিমাদের সাহায্য
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউরোপীয় কয়েকটি রাজ্য সামরিক, অর্থনৈতিক এবং মানবিকভাবে ইউক্রেনকে সাহায্য দিয়েছে বলে কিয়েল ইনস্টিটিউট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমির প্রকাশ করা উপাত্তে উঠে এসেছে।   সামরিক সাহায্যের মধ্যে রয়েছে, অস্ত্রশস্ত্র ও বিভিন্ন সরঞ্জাম। মানবিক সাহায্যের মধ্যে রয়েছে খাদ্য, চিকিৎসা সামগ্রী ও অন্যান্য ত্রাণ সহায়তা। অর্থনৈতিক সাহায্যের মধ্যে রয়েছে, অনুদান, ঋণ ইত্যাদি।  যুক্তরাষ্ট্র কিয়েভকে ৫০ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের সামরিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই সামরিক সহায়তা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠান ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক, ইইউ কমিশন ও কাউন্সিল এবং ইউরোপিয়ান পিস ফ্যাসিলিটি ৩৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার সহায়তা ইউক্রেনকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইউক্রেনকে ২০ নভেম্বর থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে যুক্তরাজ্য ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে রাশিয়ার পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টিও একাধিকবার সামনে এসেছে। তবে এখন পর্যন্ত রাশিয়া ইউক্রেনে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করেনি। ইউক্রেন বলছে, রাশিয়া এই যুদ্ধে ইরানের তৈরি কামিকাজে ড্রোন ব্যবহার করেছে। জ্বালানি স্থাপনাগুলোতে ব্যাপক আকারে ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যেই এই ড্রোন ব্যবহার করেছে রাশিয়া।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শেষ কোথায়, সেই প্রশ্ন এখনো অজানা। তবে এ যুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতিতে যে মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে, তা তাৎপর্যপূর্ণ। এ যুদ্ধে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ও মানবিক দুর্দশার শেষ কোথায় তা জানে না বিশ্ব।