ঢাকা, শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

"বারবার অপ্রকাশিত থেকে যাচ্ছে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম দরবার শরীফের অসামান্য অবদান "

মোঃ সোলায়মান টিপু | প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ০৫:২৪:০০ অপরাহ্ন | বিজয়ের ৫০ বছর
যুদ্ধ আর যুদ্ধ, চারিদিকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। দেশের জন্য কঠিন পরীক্ষা। সময়টা ছিল ১৯৭১ সাল। সমন্বিত উদ্যোগ, সংরক্ষণ এবং প্রচার ও প্রসারের অভাবে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতিই আজ হারিয়ে যাচ্ছে, অথচ মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিলে দেখা যাবে মুক্তিযুদ্ধে এসবের  অবদান কোন অংশে কম ছিলনা। আসল-  নকলের বেড়াজালে টিকতে না পেরে আরো অনেক স্মৃতির ন্যয় আস্তে আস্তে পর্দার অন্তরালে হারিয়ে যাচ্ছে এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অবদান। তেমনি একটি স্মৃতিময় পূণ্যস্থান বোয়ালখালী উপজেলাস্থ "চট্টগ্রাম দরবার শরীফ "। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই দরবারটির অসামান্য অবদান থাকা সত্ত্বেও যথাযথ স্বীকৃতি না পাওয়ায় স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এলাকাবাসীর মধ্যে তা নিয়ে চরম ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে। সরকারি উদ্যোগ ও সংরক্ষণের অভাবে দীর্ঘ সময় ধরে অপ্রকাশিতই থেকে গেছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে উক্ত দরবারটি ও দরবারের মানুষগুলোর অবদানের কথা।
দরবারের মাইজভাণ্ডারী তরিকার আধ্যাত্মিক সাধনার ভিড়ে ঢাকা পড়তে- পড়তেই তা আগামী প্রজন্ম, এমনকি বর্তমান প্রজন্মের কাছেই বিস্মৃতি হিসেবে থেকে যাচ্ছে। এলাকাবাসির সাথে কথা বলে জানা গেছে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষভাগে মুক্তিকামী বেশকিছু ছাত্র-জনতা নিরাপদ স্থান ভেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য আশ্রয় নেওয়া শুরু করে এ দরবারে। পরবর্তীতে সকলে একত্রিত হয়ে এখান থেকেই যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। দুইটি দলে বিভক্ত হয়ে একটি দল চলে যায় ভারতে ট্রেনিং নিতে এবং ট্রেনিং শেষে তারা ফিরে আসে, আবার আর একটি দল দেশে থেকে শত্রু বাহিনীকে প্রতিহত করতে যুদ্ধে অংশ নেয়। যুদ্ধকালীন এই সময়টাতেই মূলত দরবারটি মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগের কেন্দ্রস্থল ও আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। আর সেই সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা যার ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তিনি হলেন এই দরবারের প্রতিষ্ঠাতা, এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয়, কামেল পুরুষ, সুলতানুল আরেফিন, হযরত মৌলানা শাহছুফি ছৈয়দ মোহাম্মদ আব্দুল মালেক শাহ্ আল রাহে ভাণ্ডারী (কঃ)। উনি যুদ্ধের পুরোটা সময় জুড়ে  এসব মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়- প্রশ্রয় দেওয়া থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়া ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলেন। এমনকি দেশের প্রতি ভালোবাসার টানে নিজ সন্তান শাহজাদা সৈয়দ হারুন-অর-রশিদকে প্রেরণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে পাঠাতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেন নি।  যিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে  দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এনিয়ে দরবারের বর্তমান সাজ্জাদানশীন হযরত আল্লামা শাহছুফি ছৈয়দ মোহাম্মদ জাফর ছাদেক শাহ্ (মাঃ) দাবি করেন- আব্বাজান আর্থিক দিক থেকে ধনী ছিলেন না বটে, উনার অন্তর ছিল বিরাট মহীরুহের মতো। মানুষকে যেমন প্রাণভরে ভালোবাসতেন তেমন দেশাত্মবোধে বলিয়ান ছিল উনার অন্তর আত্না। তাইতো দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার অভিপ্রায়ে দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী স্থায়ী এই যুদ্ধের পুরুটা সময় প্রতিদিনই ৪০ থেকে ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে কোন প্রকার সহযোগিতা ছাড়াই একক প্রচেষ্ঠায় ঘরের যাকিছু ছিল তার সব টুকুই অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন এসব সূর্য সন্তানদের জন্য। বাড়ির মা - বোনেরা প্রায় প্রতি বেলায় রান্না- বান্নার কাজ করতে গিয়ে হাফিয়ে উঠতেন। তারপরও তারা কোনদিন নিরাশ হননি, মাতৃভূমির টানে দ্বিগুণ আনন্দ নিয়েই তারা কাজগুলো করতেন।তাছাড়া আমার শ্রদ্ধাভাজন বড় ভাই যুদ্ধকালীন প্লাটুন কমান্ডার ছৈয়দ  হারুন-অর-রশিদ নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পরবর্তীতে দরবারে আশ্রয় নেওয়া মুক্তিবাহিনীর খবর পেয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা একদিন এইবাড়ি আক্রমণের উদ্দেশ্যে এলাকায় এসেছিলেন। এই বিষয়ে হযরত শাহছুফি মৌলানা ছৈয়দ মোঃ জাফর ছাদেক শাহ্ (মাঃ) বলেন, সেদিন পরিবারের আমরা সবাই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। খবর পেয়ে মুক্তিযুদ্ধে এ অঞ্চলের নেতৃত্বদানকারী ক্যাপ্টেন করিমের তত্ত্বাবধানে তার বাহিনী পাক হানাদের পাল্টা আক্রমণের লক্ষ্যে বাড়ির পার্শ্ববর্তী কর্ণফুলীর চরে এ্যাম্বুসও নিয়েছিলেন। কিন্তু কি ভেবে এই হানাদার বাহিনী  বাড়ির পাশ দিয়ে ডেপুটি পাড়া হয়ে ফিরে গিয়েছিলো তা জানি না। তবে সেদিন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে আমরা সবাই রক্ষা পেয়েছিলাম। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক উপজেলা কমান্ডার আলহাজ্ব আবুল বাশার মহান মুক্তিযুদ্ধে এই দরবারটির অবদানের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, স্থানটি ছিল আমাদের জন্য খুবই নিরাপদ, তাই যুদ্ধকালীন সময়ে এখানে আমরা জড়ো হয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজে নেমে পড়তাম। এলাকার আবু তাহের নামের ৭৩ বছরের এক মুক্তিযোদ্ধা বলেন,১৯৭১ এর রণাঙ্গনে আমার সহযোদ্ধারা এলাকার -নুরুল ইসলাম, মোঃ ইউনুস,আবু বক্কর,ইসলাম , ছালে জহুর, কমান্ডার ইদ্রিস, আবু , কমান্ডার নুরুল ইসলামসহ আরো অনেকেই আছেন যারা তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে "চট্টগ্রাম দরবার শরীফ" ছিল অত্র এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র। এই দরবারের প্রতিষ্ঠাতা  হযরত শাহসুফি ছৈয়দ আব্দুল মালেক শাহ (কঃ)নিজের জায়গা জমি বিক্রি করে সেই টাকা ব্যয় করে তাদের আশ্রয় - প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এই দরবারের  অবদান কোন অংশে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। দরবারের প্রাণপুরুষ হযরত শাহছুফি ছৈয়দ আব্দুল মালেক শাহ্ (কঃ) এর আশ্রয় ও ওনার পরিবারের নিঃস্বার্থ সহযোগিতা না পেলে হয়তো সেদিন শত্রুর মোকাবিলা করা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যেত । কিন্তু বড়ই আফসোসের বিষয় স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও  এ দরবারটি মুক্তিযুদ্ধে এত বড় অবদানের কোন স্বীকৃতি পেল না । তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী  বর্তমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি দেশের ক্ষমতায় আসীন আছেন। সরকার এইসব যুদ্ধকালীন স্মৃতি রক্ষায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছেন । মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছেন সর্বোচ্চ সম্মান।  আমাদের দাবি তারই ধারাবাহিকতায় সরকার সেভাবে দরবারটির অবদান মূল্যায়ন করে, তাহলে বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম জানতে পারতো  আমাদের ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম দরবার শরীফ 'র অবদানের কথা।