ঢাকা, মঙ্গলবার ৭ মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

বীর মুক্তিযোদ্ধা সরদার আজিজের জন্ম, শৈশব ও কৈশোর

এমএ রহিম, সিলেট: | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ২৭ জুন ২০২৩ ০৩:৫২:০০ অপরাহ্ন | মতামত

সরদার আজিজুর রহমানসহ ১৪ ভাই বোন। এর মধ্যে ৫ ভাই বোন বেঁচে নেই। বেঁচে আছেন ৯ ভাই বোন। এরা হলেন বোন মনোয়ারা বেগম। তিনি ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানায় বসবাস করেন। কারণ তাঁর এক সন্তান ওই কারখানার চাকরিজীবি। ভাই হাফিজুর রহমান সরদার। তিনি বিসিআইসিতে চাকরি জীবন শেষে অবসরে গেছেন। বর্তমানে তিনি নিজ গ্রাম পাখিমারা গ্রামে বসবাস করেন। বোন মাহফুজা বেগম দিনাজপুর শহরে স্বামীর সাথে বসবাস করেন। ভাই সরদার সাহিদুর রহমান বসবাস করেন পাখিমারা গ্রামে। বোন লুৎফা বেগম পাখিমারা গ্রামের পাশের গ্রামে স্বামীর সাথে বসবাস করেন। সরদার আবুল কালাম আজাদ বসবাস করেন গ্রামের বাড়িতে। সরদার আবুল কাশেম বসবাস করেন ঢাকায়। চাকরি করেন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে। ভাই সরদার সাজ্জাদুর রহমান বসবাস করেন গ্রামের বাড়িতে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা সরদার আজিজুর রহমান ১৯৫৫ সালেন ১৫ জানুয়ারি নড়াইল জেলার কালিয়া থানার গল্লামারা গ্রামে দাদা মোয়াজ্জেম হোসেন সরদারের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ৬ মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের সাথে দাদার বাড়িতেই ছিলেন তিনি। ৬ মাস বয়সে মায়ের সাথে চলে যান খুলনা শহরে। খুলনা শহরে পিতা সরদার রোকন উদ্দিন আহমদ ব্যবসা করতেন। খুলনা শহরে গিয়ে মিরাপাড়াস্থ বাসায় উঠেন। সেখানেই বেড়ে উঠতে থাকেন। মা-বাবার বড় সন্তান হওয়ায় সরদার আজিজের প্রতি য়তেœর কোনো কমতি ছিল না।

৫ বছর বয়স পর্যন্ত মিরাপাড়ার ভাড়া বাসায় বসবাস করেন সরদার আজিজ। এই সময়ের মধ্যে সরদার আজিজের আরো দুই ভাই বোন্রে জন্ম হয়। তিন ভাই বোনকে নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন মা মনোয়ারা বেগম। বাল্য শিক্ষা অর্জন করতে থাকেন মায়ের কাছে। নামাজ শেষে মা মনোয়ারা বেগম তিন ভাই বোনকে কাছে ডেকে নিতেন। তখনও মা থাকতেন জায়নামাজে। তিন ভাই বোনকে কোলে বসিয়ে শেখাতেন ধর্মীয় শিক্ষার প্রথম পাঠ। আরবি হরফগুলো মুখে মুখে মুখস্ত করাতেন। বাংলা ও ইংরেজিরও অক্ষর জ্ঞান দিতেন। এভাবে মায়ের যতেœ চার বছর বয়সের মধ্যে আরবি, বাংলা ও ইংরেজির অক্ষর জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন সরদার আজিজ। মা আয়েশা বেগম অক্ষর জ্ঞান শেখাতেন আর তিন ভাই বোনের হাতে তুলে দিতেন চিড়া-মুড়ি। এতেই তিন ভাই বোন খুশি হয়ে যেতেন। রাতের বেলায় ছড়া শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন।

৫ বছর বয়সে সরদার আজিজকে পাঠশালা স্কুলে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নেন বাবা রোকন উদ্দিন আহমদ। বছরখানেক আগে বাসা পরির্তন করে আজম খান কর্মাস কলেজের পাশে বাসা ভাড়া নেন। সেখান থেকে প্রায় ২ মাইল দূরে রেলওয়ে বয়েজ স্কুলে ভর্তি করা হয় সরদার আজিজকে। সকাল ১০ টা-১২ টা ছিল স্কুলের সময়। বাবা রোকন উদ্দিন  স্কুলে আনা নেয়া করতেন সরদার আজিজকে। ৫ম শ্রেণিতে উঠার পর স্কুলের সময় পরিবর্তন হয়। সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ২ টায় পর্যন্ত স্কুলের সময়। ওই সময় আবার বাসা পরিবর্তন করা হয়। এবার নিজস্ব বাসায় গিয়ে উঠেন সরদার আজিজের পরিবার। ওই বাসাটির অবস্থান ছিল ইকবাল নগরের দোলখোলা গ্রামে। এই গ্রামের বাসা থেকে সরদার আজিজকে স্কুলে পৌঁছে দিতেন তাঁর বাবা। স্কুল ছুটি শেষে একাই হেঁটে বাসায় ফিরতেন। এই স্কুল থেকে ৫ম শ্রেণিতে উর্ত্তীণ হওয়ার পর স্কুল পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেন। খুলনার প্রথম শ্রেণির স্কুল বিকে স্কুলে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেন। ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেন। ভর্তি হন বিকে স্কুলে। মা-বাবার আদর যতেœ শিক্ষা জীবন চালিয়ে যেতে থাকেন সরদার আজিজ।

১৯৬৮ সালে সরদার আজিজ ৯ম শ্রেণির ছাত্র। এসময় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছিল। খুলনা শহরে তীব্র প্রতিবাদি ছিল ছাত্র ইউনিয়ন। নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন ছাত্রনেতা হুমায়ুন কবির বালু। তাঁর বাড়ি ছিল সরদার আজিজের বাড়ির কাছাকাছি। ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন সরদার আজিজ। ছাত্র ইউনিয়নের হয়ে প্রতিটি কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। প্রায় প্রতিদিন হুমায়ুন কবির বালুর বাসায় ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের আড্ডা হতো। ওই আড্ডায় যোগ দিতেন সরদার আজিজ। ১০ম শ্রেণিতে অধ্যায়নের সময় শুরু হয় ৬৯ এর আন্দোলন। রাজপথ আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়ে উঠে। প্রতিটি কর্মসূচিতেই সরদার আজিজ অংশ নিতেন। উত্তাল আন্দোলনে সরদার আজিজ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন নেতাদের। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৬৯ ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।

২১ ফেব্রæয়ারি ছাত্র-জনতার সাথে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় পুলিশের। এই সংঘর্ষে কয়েকজন ছাত্র ও পুলিশ মারা যায়। এই আন্দোলনের একটি গ্রæপে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সরদার আজিজ। যথারীতি অসংখ্য নিরিহ মানুষকে আসামি করে মামলা হয়। এই মামলায় আসামি হয়েিেছলেন সরদার আজিজ। পুলিশের ধরপাকড় শুরু হয়। সরদার আজিজের পিতা সন্তানকে জানিয়ে দিলেন তাঁর আর খুলনায় থাকা ঠিক হবে না। সে সময়কার খুলনার আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল আজিজের কাছে নিয়ে গেলেন সরদার আজিজকে। আবদুল আজিজ জানতে চাইলেন কোন এলাকায় সরদার আজিজকে পাঠানো যায়। আবদুল আজিজকে জানানো হলো ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানায় তাঁদের আত্মীয় আছেন। সেখানে পাঠালে ভালো হয়। আবদুল আজিজ একটি চিঠি লেখলেন এমএজি ওসমানী বরাবরে। ওই চিটি নিয়ে সরদার আজিজ রওয়ানা হন সিলেটের উদ্দেশ্যে।

ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানার আত্মীয় বাসায় এসে উঠেন। পরে চিঠি নিয়ে দয়ামীরে যান এমএজি ওসমানীর কাছে। এমএজি ওসমানী চিঠি পেয়ে সরদার আজিজকে সম্পৃক্ত করে নেন দলে। সরদার আজিজ ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানায় থাকবেন বলে জানালেন এমএজি ওসমানীকে। ওসমানীর নির্দেশনায় সরদার আজিজ ফিরে আসেন ফেঞ্চুগঞ্জের সারকারখানার আত্মীয়র বাসায়। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত হয়ে আন্দোলনে নিজকে সম্পৃক্ত করে নেন। কিন্তু ওই সময় বলতে গেলে সিলেটে অনেকটা শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছিল। এরই মধ্যে ৭০ এ সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানি শোষক গোষ্ঠি ক্ষমতা ছাড়তে রাজি নয়। এতে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। পাকিস্তানি শোষক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে প্রতিটি কর্মসূচিতে অংশ নিতে থাকেন টসবগে বয়সের সরদার আজিজ। পায়ে হেঁটে কয়েকদিন মিছিল করে সিলেট শহরেও গেছেন সরদার আজিজ। সরদার আজিজের অবস্থা প্রায় সময় খোঁজ নিতেন এমএজি ওসমানী। এই আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঘনিয়ে আসে ৭১ এর ভয়াল ২৫ মার্চ। আগে থেকেই আন্দোলনকামী সকল নেতাকর্মীকে প্রস্তুত থাকার জন্যে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছিল কেন্দ্র থেকে। নির্দেশনা অনুযায়ী সকলের সাথে নিজকে প্রস্তুত করে নেন সরদার আজিজ। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকাল বেলায় জানতে পেরেছিলেন এবার যেতে হবে যুদ্ধে। শত্রæমুক্ত করতে হবে দেশকে।