ফেনীতে পথশিশুদের মাঝে 'গ্লু স্নিফিং' বা ড্যান্ডির নেশায় আসক্ত হওয়ার প্রবনতা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেতে দেখা যাচ্ছে। আসবাবপত্র প্রভৃতি মেরামত কিংবা জোড়া লাগানোর কাজে ব্যবহৃত আঠা বা গাম পলিথিনে মুড়িয়ে সেই আঠার পাষ্প কিংবা গন্ধ শোঁকবার মাধ্যমে গ্লু স্নিফিং বা ড্যান্ডির নেশায় আসক্ত হয়ে উঠছে এসব পথশিশুরা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই নেশা বা নেশার পদ্ধতিকে 'গ্লু স্নিফিং' হিসেবে অবিহিত করা হলেও সাধারণ মানুষের কাছে এটি ড্যান্ডি হিসেবেই অধিক পরিচিত।
একসময়ে শহরের ছিন্নমূল এসব পথশিশুদের অনেকটা গোপনে কিংবা আড়ালে এই নেশায় জড়িত থাকার কথা শোনা গেলেও এখন রীতিমতো প্রকাশ্যে-দিবালোকেই ব্যস্ত শহরের আনাচে-কানাচেতে দেখা মিলছে শিশু-কিশোরদের ড্যান্ডি সেবনের চিত্র। ফেনী শহরের রেলস্টেশন, বেদেপল্লি, দোয়েল চত্বর, বিরিঞ্চি হাংকার, পুরাতন জেল গেট সহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সের এসব শিশুদের অনেকটা প্রকাশ্যেই এই নেশায় জড়িত থাকতে দেখা যায়।
শহরের বিভিন্ন হার্ডওয়্যার দোকানে ৩০ থেকে একশ টাকার মধ্যে সহজেই এই নেশার প্রধান উপাদান গাম বা আঠা পাওয়া যাওয়াতে পথশিশুদের মাঝে এই নেশায় ঝুঁকার প্রবনতা বাড়তে শুরু করেছে।
অনিয়ন্ত্রিত এসব পথশিশুদের নিয়ন্ত্রণে আনতে এরইমধ্যে তৎপরতা শুরু করেছে ফেনী জেলা পুলিশ প্রশাসন। শহরের দোয়েল চত্বর, পুরাতন জেলগেট ও রেলস্টেশন এলাকায় ড্যান্ডি আসক্ত এসব পথশিশুদের জিজ্ঞাসাবাদ ও সচেতন করতে শুরু করেছে পুলিশ, এছাড়াও তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী শহরের বিভিন্ন হার্ডওয়্যার দোকানের মালিকদের থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এছাড়াও পথশিশুদের মাঝে এসব আঠা বা গাম বিক্রি না করার শর্তে হার্ডওয়্যার দোকান মালিক সমিতির সভাপতি-সম্পাদকের জিম্মায় তাদের অঙ্গীকার নামায় স্বাক্ষর করে ছেড়ে দেওয়া হয়।
জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, সহজলভ্য হওয়ায় পথশিশুরা সহজে গাম ক্রয় করে নেওয়ায় আসক্ত হচ্ছে। তাই দোকানিদের প্রাথমিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে। এ ব্যাপারে যাচাই না করে শিশুদের কাছে গাম বিক্রি করবে না মর্মে লিখিত অঙ্গীকার করেন।
কি এই ড্যান্ডি? কিংবা পথশিশুরা এই নেশায় আসক্ত হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিডফোর্ড হাসপাতালের মেডিসিন ও জনস্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক ডা. মুহাম্মদ মুসা হাসনাত বলেন, গাম জাতীয় এই প্রকার উদ্বায়ী পদার্থ বাষ্প বা ধুম্রাকারে 'গন্ধ শোঁকা' বা শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে শ্বসনযন্ত্র হয়ে রক্তের মাধ্যমে সেবনকারীর মস্তিষ্কে প্রবেশ করে। এতে তার শরীরে সাময়িক সময়ের জন্য আনন্দের শিহরণ তৈরি হয়, আর তৈরি হয় অনিয়ন্ত্রিত উন্মাদনা, যা পরবর্তীতে দেহে আনে এক শিথীলতার ভাব। দীর্ঘ মেয়াদে এই পদার্থের অপব্যবহারের ফলে এর প্রতি সৃষ্টি হয় এক চরম আসক্তি।
সমাজের সুবিধা বঞ্চিত প্রান্তিক কিশোর-কিশোরী,সদ্য বয়োপ্রাপ্ত শ্রেনী,নেশার প্রতি কৌতুহল প্রবণ কিশোর-কিশোরী,শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার অল্প বয়স্ক জনগোষ্ঠী,আচরণগত সমস্যায় আক্রান্ত শিশু ও হতাশা, উদ্বিগ্নতা, অত্যধিক মানসিক চাপে থাকা জনগোষ্ঠীর শিশুদের মাঝেই এই নেশায় আসক্ত হওয়ার প্রবনতা বেশি দেখা যায় বলে জানান মুসা হাসনাত।
'গ্লু স্নিফিং' এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাথা ঘোরা, চলাচলে অসংলগ্নতা, কথা জড়িয়ে আসা, হাত-পা কাঁপা, ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব, রক্ত বমি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। এমনকি নেশার অতিমাত্রায় নিউমোনিয়া, হার্ট ফেইলিউর কিংবা শ্বাসরোধ বা দুর্ঘটনার কারণে এই নেশায় আসক্ত ব্যাক্তির মৃত্যুও ঘটতে পারে। এছাড়াও যক্ষা, এইডস,যৌন বাহিত নানা রোগ,অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস, লিভার সিরোসিস, লিভার ও ফুসফুসের ক্যান্সারের সংক্রমণ ও ঘটতে পারে বলে জানান তিনি।
এই নেশায় আসক্ত অধিকাংশ শিশু-কিশোররা শারীরিক, মানসিক উভয় সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে বলে জানান মুসা হাসনাত।