![](https://dainikbayanno.com/storage/pic-3.jpg)
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা পরিষদ আইনের সংস্কারের দাবিতে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে Dialogue for Peace of Chittagong Hill Tracts । বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সংগঠনটির নেতারা এই স্মারকলিপি হস্তান্তর করেন। স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, বিদ্যমান আইনে জাতিগত বৈষম্য রয়ে গেছে, যা স্থানীয় জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে এবং রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্যও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বারকলিপিতে বলা হয়, জাতিগত বৈষম্য দূর করে ‘উপজাতি’ ও ‘অ-উপজাতি’ শব্দ পরিবর্তন করে স্থায়ী বাসিন্দাদের জাতিগত পরিচয় ব্যবহার করতে হবে। সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা – জেলা পরিষদে প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে জনসংখ্যানুপাতে সকল জনগোষ্ঠীর জন্য আসন বরাদ্দ করা। চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদের জন্য উন্মুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা –বর্তমান আইনে শুধুমাত্র ‘উপজাতীয়’ পরিচয়ধারীরা চেয়ারম্যান হতে পারেন,যা বৈষম্যমূলক। জমি ক্রয়-বিক্রয়ে জেলা পরিষদের অনুমোদন বাতিল করা –ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানার ওপর অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা। আঞ্চলিক পরিষদ আইন, বাজার ফান্ড জমিজামা সংক্রন্ত আইন, উন্নয়ন বোর্ড আইন বাতিল করাসহ বিভিন্ন দাবি সমূহ তুলে হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তির জন্য সংলাপ (ডিপিসি) নেতৃবৃন্দ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা রাঙামাটি,খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান জেলার স্থানীয় সরকারগুলোর মধ্যে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন,১৯৮৯ (সংশোধিত ১৯৯৮), রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৯ (সংশোধিত ১৯৯৮), বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৯ (সংশোধিত ১৯৯৮)এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন,১৯৯৮ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই আইনগুলো প্রণয়নের সময় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সকল নাগরিকের জন্য সমতা, ন্যায্যতা, মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকারের ব্যাপারে সুবিবেচনা করা হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না।
এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনকে পুরোপুরি অসাংবিধানিক ও এককেন্দ্রিক শাসন কাঠামোর পরিপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করে আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও পরিষদকে বাতিল করে উচ্চ আদালত রায় প্রদান করেছে। আমরাও বিশ্বাস করি যে, আঞ্চলিক পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ আইন অসাংবিধানিক এবং রাষ্ট্রের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি হিসেবে সম্পূর্ণরূপে বাতিলযোগ্য। তবে তিনটি (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান) পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে কিছু সংশোধনী এনে তা সকল নাগরিকদের জন্য সম্মানজনক ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করার দাবি জানান। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন প্রায় একই হওয়ার কারণে এখানে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন,১৯৮৯ (সংশোধিত ১৯৯৮) এর কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীর প্রস্তাব করছি। যেসব সংশোধনী অপর দুটি জেলা পরিষদ আইনের ক্ষেত্রেও (প্রায়) প্রযোজ্য হবে।
এসময় উপস্থিত ছিলেন, সংগঠনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোঃ হারুন অর রশীদ, ভাইস-চেয়ারম্যান সাংবাদিক এম. কামাল উদ্দিন, নির্বাহী পরিচালক এড.কামাল হোসেন সুজন, পরিচালক (দপ্তর) এড.আলাল উদ্দিন, পরিচালক (অর্থ) এড.মুন্না সদ্দার, পরিচালক এড.জিল্লুর রহমান, পরিচালক এড.আমিরুল ইসলাম, এড.রাকিব হোসেন, শিক্ষানবীশ আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন, শিক্ষানবীশ আইনজীবী আইনুল হক ও আইনজীবীর সহকারী নুর হোসনসহ আরো অনেকে।
এছাড়া জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট জাতিগত বৈষম্যেমুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যাশায় স্বারকলিপিতে কতিপয় আইনের সংশোধনী ও ১৬ দফা দাবি দেয়া হয়। যার মধ্যে রয়েছে, জেলা পরিষদ আইনের সূচনা অংশে উপজাতীয় অধ্যুষিত একটি বিশেষ এলাকা শব্দগুচ্ছটি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র অনগ্রসর এলাকা উল্লেখ করা উচিত। কারণ, এতে অ-উপজাতীয় বাসিন্দাদের মধ্যে বিভক্তি ও ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া, উপজাতীয় ও অ-উপজাতীয় শব্দদ্বয়ের পরিবর্তে বসবাসরত জনগোষ্ঠির নির্দিষ্ট নাম ব্যবহার করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আইনের ধারা-৪ অনুযায়ী, জেলা পরিষদে ২০ জন উপজাতীয় সদস্য ও ১০ জন অ-উপজাতীয় সদস্য রাখার বিধান রয়েছে, যা পরিবর্তন করে জনসংখ্যার ভিত্তিতে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে। এতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, বোমসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠির নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রতিনিধি রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। একইভাবে, চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট জাতির শর্ত তুলে দিয়ে সকল জনগোষ্ঠির জন্য উন্মুক্ত রাখার দাবি জানানো হয়েছে।
আইনের ধারা-১৭ সংশোধন করে বলা হয়েছে, জেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটার তালিকা জাতীয় ভোটার তালিকার ভিত্তিতে হওয়া উচিত। বর্তমানে পৃথক ভোটার তালিকা তৈরির যে বিধান রয়েছে, তা অবৈধ উল্লেখ করে এই বিধান বাতিলের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে পৃথক জেলা পুলিশ গঠনের বিধান বাতিলের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এটি বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন করে অশান্তি তৈরি হতে পারে। পাশাপাশি, জেলা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ের বিধানও বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে।
উচঈ-এর পক্ষে স্মারকলিপি প্রদানকালে সংগঠনের পরিচালক অ্যাডভোকেট আলাল উদ্দিন বলেন, বিদ্যমান আইনগুলো রাষ্ট্রের বিভিন্ন জনগোষ্ঠির মধ্যে বৈষম্য তৈরি করেছে। এগুলো পরিবর্তন না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে টেকসই উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। স্মারকলিপিতে অনুরোধ করা হয়েছে, অন্তর্র্বতী সরকারের গঠিত স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন যেন এই সংশোধনীসমূহ বিবেচনা করে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চললেও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ পরিস্থিতির কারণে এই অঞ্চলকে এখনও সমাধানের আওতায় আনা হয়নি। উচঈ মনে করে, সংস্কারের মাধ্যমে সকল সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা সম্ভব হবে।
বায়ান্ন/প্রতিনিধি/পিএইচ