২০১২ সালে ৬ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয় দেশের চা বাগানগুলোতে। ওই বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছিল ১৫ লাখ ৬০ হাজার কেজি চা। ২০২১ সালে বাংলাদেশে রেকর্ড ৯ কোটি ৬৫ লাখ ১০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। সে হিসেবে ১০ বছরে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি। কিন্তু ২০২১ সালে চা রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৬ লাখ ৮০ হাজার কেজি চা। অংকের হিসেবে ১০ বছরের ব্যবধানে চা রপ্তানি দাঁড়িয়েছে অর্ধেকের চেয়েও কমে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে রপ্তানি কমে গেছে।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের সদস্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী বলেন, ‘দেশীয় চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে রপ্তানি কমে গেছে। তবে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নানান পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। এর মধ্যে বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান করার নানান উদ্যোগ বাস্তবায়ন হচ্ছে। এরই মধ্যে তার সুফলও আসছে।’
সবাই মনে করেন, রপ্তানি হওয়া চা সবচেয়ে ভালো। কিন্তু বিষয়টি সঠিক নয়। আমাদের দেশের মানুষেরা ভালো চা খায়। প্রতিনিয়ত চায়ের জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। যে কারণে ১০ বছর আগে যেখানে ৬৫ মিলিয়ন কেজি চায়ের চাহিদা ছিল, এখন সেখানে কমবেশি ৯০ মিলিয়ন কেজির চাহিদা তৈরি হয়েছে
বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য পর্যালোচনা করলে চায়ের উৎপাদন, রপ্তানি ও ব্যবহারের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য মতে, ২০১২ সালে ৬ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজার কেজি, ২০১৩ সালে ৬ কোটি ৬২ লাখ ৬০ হাজার কেজি, ২০১৪ সালে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ৮০ হাজার কেজি, ২০১৫ সালে ৬ কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার কেজি, ২০১৬ সালে ৮ কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার কেজি, ২০১৭ সালে ৭ কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার কেজি, ২০১৮ সালে ৮ কোটি ২১ লাখ ৩০ হাজার কেজি, ২০১৯ সালে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার কেজি, ২০২০ সালে ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৯০ হাজার কেজি এবং সর্বশেষ ২০২১ সালে ৯ কোটি ৬৫ লাখ ১০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছে।
চা বোর্ডের হিসাব মতে, দেশে বর্তমানে ১৬৭টি বৃহৎ চা বাগান এবং প্রায় ৮ হাজারের বেশি ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান রয়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে রপ্তানি হয়েছিল ১৫ লাখ ৬০ হাজার কেজি। পরে ২০১৩ সালে ৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা রপ্তানি করলেও ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ ২৬ লাখ ৬০ হাজার কেজি চা রপ্তানি হয়। একইভাবে ২০১৭ সালে ২৪ লাখ ৭০ হাজার কেজি এবং ২০২০ সালে ২১ লাখ ৭০ হাজার কেজি চা রপ্তানি হয়েছে।
ভালো চায়ের জন্য, ভালো পাতা প্রয়োজন। ভালো, নরম পাতা পেতে হলে চায়ের উন্নত ক্লোনের প্রয়োজন হয়। ভালো জাতের গাছ প্রয়োজন। ভালো চা উৎপাদনের জন্য প্রকৃতি পরিবেশ একটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। আবার ভালো মানের চা তৈরির জন্য কারখানার পরিবেশও উন্নত করতে হয়। আমরা এসব বিষয়টি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। যাতে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি মানসম্মত চা উৎপাদন করা সম্ভব হয়
তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিগত ১০ বছরের মধ্যে ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ ২৬ লাখ ৬০ হাজার কেজি চা রপ্তানি হয়েছে। অথচ ওই বছর চায়ের উৎপাদন হয়েছে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ৮০ হাজার কেজি। কিন্তু পরের বছর ৮ কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হলেও রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৪ লাখ ৭০ হাজার কেজি।
একইভাবে ২০১৯ সালে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার কেজি উৎপাদন হলেও রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৬ লাখ কেজি। পরের বছর ২০২০ সালে প্রায় ৯৭ লাখ কেজি কমে উৎপাদন দাঁড়ায় ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৯০ হাজার কেজি। কিন্তু ওই বছর রপ্তানি হয়েছে আগের বছরের তুলনায় তিনগুণের বেশি। ২০২০ সালে ২১ লাখ ৭০ হাজার কেজি চা রপ্তানি হয়।
চায়ের উৎপাদন ও মান নিয়ে কথা হলে এইচআরসি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, আমাদের টি বোর্ড চা উৎপাদনকে সংখ্যার ভিত্তিতে বিচার করে। এটাকে মানের ভিত্তিতে বিচার করা উচিত। আমাদের দেশে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে, এটা সত্য, কিন্তু মানসম্মত চায়ের পরিমাণ কম বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, সবাই মনে করেন, রপ্তানি হওয়া চা সবচেয়ে ভালো। কিন্তু বিষয়টি সঠিক নয়। আমাদের দেশের মানুষেরা ভালো চা খায়। প্রতিনিয়ত চায়ের জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। যে কারণে ১০ বছর আগে যেখানে ৬৫ মিলিয়ন কেজি চায়ের চাহিদা ছিল, এখন সেখানে কমবেশি ৯০ মিলিয়ন কেজি চাহিদা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ চা সংসদ চট্টগ্রাম ব্রাঞ্চের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রামে বর্তমানে ২২টি চা বাগান রয়েছে। ২০২০ সালে চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রায় এক কোটি ১৪ লাখ কেজি। ২০২১ সালে ৯৬ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়।
তিনি বলেন, ২০২১ সালে জুন পর্যন্ত চট্টগ্রাম অঞ্চলে বৃষ্টি হয়নি। জুন মাসে যে বৃষ্টি হয়েছে, তাতে গাছ পত্র-পল্লব মেলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। যে কারণে উৎপাদন কম হয়েছে। ২০২২ সালের শুরুতে বৃষ্টি ছিল, পরে কিছু খরা গেছে, তাতে গাছের পাতা কম। তবে এপ্রিল মাসের পর থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে আশানুরূপ উৎপাদন হতে পারে বলে জানান তিনি।
এ অভিজ্ঞ চা উৎপাদনকারী বলেন, চট্টগ্রাম খরাপ্রবণ এলাকা। সিলেটের চেয়ে চট্টগ্রামে আনুপাতিক বৃষ্টিপাত কম। এখানে খরা মোকাবিলার জন্য কৃত্রিম লেক সৃষ্টি প্রয়োজন। সেচের জন্য মেশিনারিজ প্রয়োজন।
সরকার প্রণোদনা দিয়ে চট্টগ্রামের বাগান মালিকদের সহযোগিতা করলে এ অঞ্চলের বেশি চা উৎপাদন সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, দেশের বাগানে মানসম্মত চা উৎপাদনের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মূলত ভালো চায়ের জন্য, ভালো পাতা প্রয়োজন। ভালো, নরম পাতা পেতে হলে চায়ের উন্নত ক্লোনের প্রয়োজন হয়। ভালো জাতের গাছ প্রয়োজন। ভালো চা উৎপাদনের জন্য প্রকৃতি-পরিবেশ একটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। আবার ভালো মানের চা তৈরির জন্য কারখানার পরিবেশও উন্নত করতে হয়। আমরা এসব বিষয় লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। যাতে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি মানসম্মত চা উৎপাদন করা সম্ভব হয়।
এ চা গবেষক বলেন, ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৮ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হতো। তখন ১৫ মিলিয়ন কেজি রপ্তানি হতো। তখন দেশের মানুষের কাছে চায়ের কদর ছিল। পরে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে চায়ের উৎপাদন ৩১ মিলিয়ন কেজিতে দাঁড়ায়। আশির দশকে চায়ের নতুন নতুন প্রযুক্তি আসে আমাদের দেশে। নতুন নতুন বড় চা বাগানও হয়। ধীরে ধীরে চায়ের দাম কম। মানুষের মাঝে চায়ের জনপ্রিয়তাও বেড়েছে। এখন ২০২১ সালে চায়ের উৎপাদন দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৯৬ মিলিয়ন কেজিতে। পাশাপাশি চায়ের চাহিদাও আগের চেয়ে বেড়েছে। চা এখন জনপ্রিয় পানীয়।
জানা যায়, বাংলাদেশে চায়ের চাষাবাদ প্রথম শুরু হয় ১৮৪০ সালে। চট্টগ্রামে কুন্ডুদের বাগান নামে সেই চা বাগান হলেও পরে সফলতার মুখ দেখেনি। পরে ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। এরও প্রায় ১০০ বছর পরে ১৯৫৭ সালের ৪ জুন চা বোর্ড গঠিত হয়। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ চা বোর্ড হিসেবে পরিচয় লাভ করে।