ঢাকা, শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

নতুন সরকারের পুরোনো চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি

অর্থনীতি ডেস্ক : | প্রকাশের সময় : বুধবার ১০ জানুয়ারী ২০২৪ ০৭:৪৬:০০ অপরাহ্ন | অর্থনীতি ও বাণিজ্য

শপথ নিয়েছে বাংলাদেশের নতুন সরকার। এর সাথে সাথে শুরু হয়েছে তাদের নতুন চ্যালেঞ্জ।

 

সঙ্গে রয়েছে পুরোনো কিছু, যার মধ্যে প্রধান মূল্যস্ফীতি। নাগরিকদের জীবন-যাত্রার উচ্চ ব্যয় নিরসন, ডলারের বিনিময় হারের পাগলা ঘোড়া থামানো, রিজার্ভ আরও নিচে নামতে না দেওয়া, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী জোরদার ও বাজেট ঘাটতি সামাল দেওয়ার মতো চার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সরকারকে তাদের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।

বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলোর প্রবল বিরোধিতা মোকাবিলা করে গত ৭ জানুয়ারি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব নিয়েছে। বুধবার (১০ জানুয়ারি) সকালে শেরেবাংলা নগরের সংসদ ভবনের পূর্ব ব্লকের প্রথম লেভেলের শপথ কক্ষে শপথবাক্য পাঠ করেছেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা।

 

বৈশ্বিক ও স্থানীয় অর্থনৈতিক সংকটের ধারাবাহিকতায় এ সরকারকে বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পুরোনো চ্যালেঞ্জগুলো সরকারের সামনে নতুন করে আবির্ভূত হবে। অর্থনীতিতে এ সমস্যা যতটা চেনা, ততটাই ঝুঁকির।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, পুরোনো সব সমস্যাগুলোকে কাঁধে নিয়ে নতুন সরকারকে দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। যত কঠিনই হোক, নির্বাচনী ইশতেহারে এসব স্বীকার করা হয়েছে। সরকার সমাধানের কর্মপন্থাও ঠিক করেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনে তৈরি হওয়া উচ্চ ব্যয় জনিত কষ্ট লাঘব, অস্থির ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে আনার মধ্য দিয়ে ছোট বিনিয়োগকারীদের উৎপাদনে টিকিয়ে রাখা, নতুন বিনিয়োগে সহায়তা অব্যাহত রাখা; রিজার্ভ আরও নামতে না দেওয়া এবং আয় বিবেচনা করে বাজেট বাস্তবায়নে মুনশিয়ানার পরিচয় দিতে হবে সরকারকে।

 

বিগত বছরে ডলার সংকটের কারণে ছোট উদ্যোক্তাদের কাঁচামাল আমদানিসহ নানা ধরনের চাপে পড়তে হয়েছে। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেলেও বাজার থেকে ডলার পেতে কষ্ট হয়েছে। অনেক সময় বেশি দাম দিয়েও পাওয়া যায়নি। এ রকম একটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

 

সাধারণত ইশতেহারে অঙ্গীকার করা হয়, কিন্তু এর বিস্তারিত বলা হয় না। নতুন সরকারে দায়িত্ব নিতে যাওয়া দলটির ইশতেহার ব্যতিক্রম। সরকারের প্রধান কাজ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। প্রথমত, সুদ হার ব্যবহার করে চাহিদার মূল্যস্ফীতির মোকাবিলা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি করে সরবরাহের দিকটি ঠিক রাখতে হবে। পাশাপাশি যারা মূল্যস্ফীতির শিকার, নিম্ন আয়ের মানুষ ও অনানুষ্ঠানিক কাজ করে এমন অতি দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে কম দামে চাল বিক্রি করা, বিভিন্ন ভাতা জোরদার ও অব্যাহত রাখতে হবে।

 

মূল্যস্ফীতির আরেকটি কারণ ছিল ডলার ও টাকার বিনিময় হার। ডলারের দামে ব্যাংক ও খোলা বাজারে বড় ধরনের হেরফের হয়ে গেছে। সেটা নিয়ন্ত্রণ হলে বাণিজ্যে ভারসাম্য আসবে বলে মনে করেন আতিউর রহমান।

 

ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন আছে। আছে বৈশ্বিক নানা সংকটজনিত অভিঘাতও। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, নতুন সরকারকে নতুন করে পুরোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। আর্থিক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখিত সামষ্টিক অর্থনীতির পাশাপাশি আর্থিক খাতে যে সুশাসনের কথা বলেছে, দুর্নীতি আছে- এগুলো আরও বেশি দেদীপ্যমান হবে। নতুন বছরে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। সংস্কার কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন হবে।

 

আওয়ামী লীগ গত সরকারে থাকা অবস্থায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়, ফলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে প্রবাসীরা সঞ্চয়কৃত অর্থসহ দেশে ফিরতে শুরু করেন। করোনাকালে যারা বিদেশে থাকেন তারাও দেশে অর্থ পাঠানোর হার বাড়িয়ে দেন। এ  সময় বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ডলার কেনার কারণে রিজার্ভের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসী আয় ওঠে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারে।

 

এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার উল্টো পরিস্থিতি হয়। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হতে হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। এরই মধ্যে আইএমএফ ঋণের দুই কিস্তি পায় বাংলাদেশ।

 

আইএমএফ’র শর্ত অনুযায়ী গত জুন শেষে নিট রিজার্ভ থাকার কথা ছিল ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার। কিন্তু তা ছিল ২ হাজার ৪৭ কোটি ডলার। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আইএমএফকে জানানো হয়, সংসদ নির্বাচনের পর রিজার্ভ ও রাজস্ব আয় অর্জনের শর্ত পূরণ সম্ভব হবে। এর আইএমএফ রিজার্ভ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে শর্ত কিছুটা শিথিল করে। আইএমএফের নতুন শর্ত অনুযায়ী, বিদায়ী মাস ডিসেম্বরে প্রকৃত রিজার্ভ রাখার কথা এক হাজার ৭৭৮ কোটি ডলার। আগামী মার্চ মাসে তা এক হাজার ৯২৬ কোটি ডলার ও জুনে দুই হাজার ১০ কোটি ডলারে উন্নীত করতে হবে।

 

এ বিষয়ে আতিউর রহমান বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আমদানি বাণিজ্যে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে। নতুন বছরে ‍যে কোনোভাবেই হোক বৈদেশিক মুদ্রার বর্তমান রিজার্ভ ধরে রাখতে হবে।  

 

বাংলাদেশের তিন ভিত্তি কৃষি, প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়। এর মধ্যে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। গত বছরে ১২ লাখের বেশি মানুষ দেশ থেকে বিদেশে কাজ নিয়ে গেছে। তারা যে পরিমাণ প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছে তা যথেষ্ট নয়। ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রবাসীরা আয়ের বড় অংশ আসছে হুন্ডির মাধ্যমে। পুরাতন বছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে ফিরিয়ে আনার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল নতুন বছরে অব্যাহত রাখতে হবে। নতুন বছরে ডলারে মূল্য বাজারের কাছাকাছি নিয়ে আসতে হবে। এটা করা সম্ভব হলে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ আরও বাড়বে। ডলারে বাজারে যে অস্থিরতা তা দূর হবে, রিজার্ভে টান পড়বে না।

 

কৃষিতে বাংলাদেশ ভালো করছে। আলু, রসুন, পেঁয়াজের মতো মসলা পণ্য আমাদের আমদানি করতে হয়। এগুলো নিয়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। ঘাটতি দেখা দিলে কতিপয় ব্যবসায়ী সুযোগ নেয়। এ জন্য সরবরাহ বাড়াতে হবে। আশপাশের দেশ থেকে আমদানি করতে মধ্যমেয়াদী চুক্তি করতে হবে। প্রতি বছর নির্দিষ্ট পরিমাণ পাওয়া যাবে- এমন কোটা পদ্ধতি সৃষ্টি করতে হবে।

 

ভোগ্যপণ্য ও গম আমদানি করার ক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তা এখনও বিদ্যমান। নতুন করে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলার মধ্য দিয়ে আরেক সংকট যোগ হয়েছে। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে প্রভাব পড়বে। এগুলো খুব বুদ্ধি দিয়ে মোকাবিলা করার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। এসব ক্ষেত্রে পণ্য আমদানিতে কানাডা বা আরও কোথাও পাওয়া যায় তা খুঁজতে হবে। মোট কথা পণ্য সংগ্রহের বিষয়টি বহুমুখী করতে হবে।

 

মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে সর্বোপরি বাজার বাজার পর্যবেক্ষণ জোরদারে তাগিদ দিয়েছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, বাজার মনিটরিং স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডেরই অংশ। এটা জোরদার করতে হবে। ২০২৩ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের অধিদপ্তরসমূহ চেষ্টা করেছে। সার্বিক মুদ্রাস্ফীতি যখন বেশি থাকে তখন এটা নিয়ন্ত্রণে প্রধান পদক্ষেপ নিতে হয় অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে। বিদায়ী বছরে আর্থিক খাতের মূল এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত থাকতে দেখা গেছে; যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি। নতুন বছরে নতুন সরকার সেই স্থবিরতা থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ পাবে।