ঢাকা, শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শুধু নিজে সফল হইনি পাশাপাশি অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে

মাজেদুল ইসলাম হৃদয়, বালিয়াডাঙ্গী (ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধি: | প্রকাশের সময় : বুধবার ১৩ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৩১:০০ পূর্বাহ্ন | অর্থনীতি ও বাণিজ্য



সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান বন্ধে ও কর্মসংস্থান এর সুযোগে ভূমিকা রাখছে পাপোশ কারখানা। এমনি সৎ উপার্জনে ভাগ্য গড়ার পথ দেখিয়েছেন ফইজুল নামে এক যুবক। ফইজুলের বাবার ভিটেমাটি ছাড়া অল্প কিছু জমি ছিল তা দিয়ে যা আয় হত তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিল পরিবারটি।

পরে ফইজুর উপায় না পেয়ে ২০১০ সালে কাজের সন্ধানে চলে যান নারায়নগঞ্জে । সেখানে টানা ৪ বছর একটি পাপোশ কারখানায় কাজ করেন। দক্ষতা অর্জন করে নিজ সীমান্ত এলাকায় ২০১৪ সাল থেকে ২টি মেশিন বসিয়ে পাপোশ বানানোর কাজ শুরু করে। ব্যবসায় লাভজনক হওয়ায় কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসার পরিধি বাড়িয়ে নিজে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি অর্ধশত পরিবারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তার কারখনায়।
 
ফয়জুর রহমান বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের বালীয়াডাঙ্গী উপজেলার বড় পলাশবাড়ী ইউনিয়নের জিয়াখোর গ্রামে। পারিবারিক জীবনে দুই কন্যাসন্তানের বাবা ফয়জুর। স্ত্রী, ভাই ও বৃদ্ধা মাসহ পরিবারের সদস্যসংখ্যা ছয়জন। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা, সংসারের ভরণ-পোষণ, ভাই ও সন্তানদের পড়াশোনার খরচ, সবকিছু চলে তার কারখানার আয় দিয়ে।

জানা যায়, বর্তমানে কারখানাটিতে প্রতিদিন ঝুট কাপড় দিয়ে প্রায় ১৫‌'শ নানা ধরণের পাপোশ উৎপাদন হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় ডিজাইনের পাপোশ তৈরি করে সাড়া ফেলেছেন দেশজুড়ে। তার কারখানায় তৈরি পাপোশ এলাকা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হচ্ছে।

আরও জানা যায়, কারখানার ভেতরে ২৫ টি মেশিনে ৪৫ জন পুরুষ কাজ করলেও।  ওই গ্রামের নারীদেরও বাড়ীতে বাড়ীতে মেশিন বসিয়ে আয়ের পথ করে দেন ফইজুর। বাড়ির পাশে কাজ পেয়ে সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন চোরাচালান বন্ধে ভূমিকা রাখবে বলে জানান স্থানীয়রা।

কারখানায় কাজ করা কলেজ ছাত্র সুমন বলেন, আমি পড়াশোনার পাশাপাশি অবসর সময়ে পাপোশ তৈরির কাজ করে থাকি। এখান থেকে যা রোজগার হয়, তা দিয়ে আমার পড়াশোনার খরচ হয়ে যায়। কখনো আবার এ রোজগার দিয়ে পরিবারকেও সহযোগিতা করি।

কারখানায় কর্মরত আলম বলেন, আমরা পরিবার অসচ্ছল। আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ। ভারী কাজ করতে পারি না। বাড়ির পাশে এই কারখানা থাকায় পাপোশ তৈরির কাজ করে থাকি৷ একটি পাপোশ তৈরি করলে ৭ থেকে ১০ টাকা পাই। সারা দিন কয়েকটা পাপোশ তৈরি করে যায় আয় হয়, তা দিয়ে আমি ও আমার সংসার চলে।

কর্মরত মমিনা খাতুন বলেন, আমরা আগে বাসায় বসে থাকতাম । পরিবারের অনেক অভাব অনটন ছিল। এখন বাড়ীর পাশে কাজ করে যা আয় হয় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ও পরিবারের সহায়তা হয়্ এখানে একটা পাপোশ তৈরি করতে ২০ মিনিট সময় লাগে। একটা তৈরি করতে পারলে ৭ থেকে ১০ টাকা পাওয়া যায়। সংসারের কাজ শেষ করে এখানে কাজ করি। দিনে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা হয়।

ফয়জুরের সফলতা দেখতে ও সফলতার গল্প শুনতে অনেকেই আসেন। অনেক বেকার যুবকও আসেন তার কাছ থেকে পরামর্শ নিতে। ফয়জুর সবাইকে তার গল্প শোনান এবং উৎসাহ দেন। এতে অনেকেই উদ্বুদ্ধ হন।

কারখানা দেখতে আসা এমন একজন আব্বাস আলী। তিনি বলেন, আমি জানতে পারলাম যে ফয়জুর ভাই পাপোশ কারখানা দিয়েছেন। তার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করি। আমাকে বললেন উনি এ কারখানা দিয়ে লাভবান হয়েছেন। আমাকে সরাসরি দেখতে আসার জন্য বলেন। তাই আমি দেখতে এসেছি। দেখে ভালো লাগল কারখানাটি। এটি সফলতার পাশাপাশি অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছি। আমি আমার এলাকায় এমন একটি কারখানা দেওয়ার জন্য সার্বিক বিষয়ে পরামর্শ নিয়েছি।

উদ্যোক্তা ফয়জুর রহমান বলেন, অভাবের কারণে আমি বাড়ি ছেড়ে ঢাকা যায়। সেখানে পাপোশ তৈরির কারখানায় কাজ করি। এতে আমি শিখে যাই পাপোশ তৈরি। কিন্তু ভাবতে থাকি বাড়িতে ফিরে যাব। পরে আমি ঢাকা থেকে কিছু পুঁজি নিয়ে গ্রামে চলে আসি। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে প্রথমে শুরু করি পাপোশ তৈরি। ধীরে ধীরে ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে। আমার পাপোশ বিক্রিও বেড়ে যায়। সেদিন ফিরে না এলে হয়তো আমি সফল হতাম না।

তিনি আরও বলেন, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কারখানা পরিচালননা করতে হচ্ছে। আমাকে যদি কম সুদে ঋণ দেওয়া হয় , তাহলে আমি কারখানাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব ইনশাআল্লাহ।

দৈনিক কতগুলো পাপোশ তৈরি হয়, জানতে চাইলে ফয়জুর বলেন, প্রত্যক শ্রমিক দৈনন্দিন ছোট পাপোশ ৬০টি, মাঝারি ৩০টি ও বড় পাপোশ ১৫টি প্রস্তুত করতে পারেন। প্রত্যেক পাপোশ তৈরিতে প্রকারভেদে ৭, ১৫, ৩০ টাকা দেওয়া হয় শ্রমিকদের। আমার তৈরি বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় ডিজাইনের পাপোশ দেশে চাহিদা বাড়ছে।

লাভ বিষয়ে তিনি বলেন, কারখানায় তৈরি এসব পাপোশ বগুড়া, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বড় বাজারে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করা হয়। শ্রমিকদের বেতন, অন্যান্য খরচাদি পরিশোধ করার পর মাসিক আয় থাক ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।

স্থানীয় সমাজসেবক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ফয়জুরের শুধু নিজে সফল হননি, পাশাপাশি অনেক মানুষের কর্মসংস্থানও হয়েছে। আমরা তার এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। আমরা আশা করছি সে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পাবে। সেই সঙ্গে এলাকার বেকারত্ব কিছুটা হলেও ঘুচে যাবে।

জেলা বিসিক শিল্প নগরীর উপব্যবস্থাপক নুরুল হক বলেন, আমরা উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছি। ফয়জুরের সফলতার গল্প অনেক বেকার যুবককে স্বপ্ন দেখাবে বলে মনে করছি। তার কারখানাটির প্রসারের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা থাকবে। সেই সঙ্গে যারা উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী, তাদের সার্বিক সহযোগিতা করব।