শাহেরা খাতুন(৪০) সে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার মুসলিম ব্লকের বাসিন্দা ইব্রাহিম খলিলের স্ত্রী ।
তাদের দুজনের নেই কোন অনলাইন জন্মনিবন্ধন,তাদের দুই মেয়েকে বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য লাগবে পিতা ও মাতার অনলাইন জন্মনিবন্ধন। এ নিয়ে নানা জটিলতায় আছেন তারা । একদিন এলাকা সূত্রে জানতে পারলেন তথ্যসেবা কেন্দ্রে জন্মনিবন্ধন করতে সাহায্য করা হয়।
তড়িঘড়ি পারিবারিক কৃষিকাজ তামাক চাষ ফেলে রেখে চলে আসেন নিকটবর্তী তথ্যকেন্দ্র বাঘাইছড়িতে, তিনি খুব ভারক্রান্তমনে সমস্যার কথাগুলো শেয়ার করলেন তথ্য আপাকে। তথ্যসেবা কর্মকর্তা সব কথা শুনে তাদের যা যা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে তা আনতে বললেন,প্রাথমিক ভাবে নতুন জন্মনিবন্ধনের অনলাইন আবেদন করে দেওয়া হল এবং জন্মনিবন্ধন কেন করা হয়নি তার প্রত্যায়ন পত্র লিখে কাউন্সিলর সাইন নিয়ে পৌরসভায় পাঠানো হল। তথ্যসেবা কর্মকর্তা তাদের জন্মনিবন্ধন যেন দ্রুত পেতে পারে তার সার্বিক সহযোগিতার জন্য যোগাযোগ করে দিলেন পৌরসভার উদ্যোক্তার সাথে।
শাহেরা খাতুনের দুই মেয়ে বাঘাইছড়ি দাখিল মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। ছোট মেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েন। মেঝো মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠেছেন,বড় মেয়ে নবম শ্রেণীতে ভর্তি করাতে পারছে না টাকার অভাবে।
একদিন কান্না করে তথ্যআপাকে শাহেরা খাতুন বললেন অর্থের অভাবে পড়াতে পারছে না বড় মেয়েকে। বিষয়টি নিয়ে তথ্যআপা তিনি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলে সার্বিক সহোগিতা করে দিলেন। মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক(সুপার) বিষয়টি আমলে নিয়ে একজনের ভর্তি ও বেতন মৌকুফ করে দেওয়ার আশ্বস্ত করলেন। পাহাড়ে শাহেরা খাতুন একা নন প্রতিদিন পাহাড়ের এ উপজেলার অসংখ্য নারী সেবা নেন বাঘাইছড়ির এ তথ্যকেন্দ্র থেকে ।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় মহিলা সংস্থা কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন তথ্যআপা: ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়)এর পরিচালিত হচ্ছে বাঘাইছড়ি তথ্যকেন্দ্র থেকে।
পাহাড়ে এ প্রকল্পের আওতায় তথ্য আপা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে দরিদ্র নারীদের তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক বিভিন্ন সেবা প্রদান করে আসছেন। দেখাগেছে প্রত্যন্ত পাহাড়ের অঞ্চলে গিয়ে উঠান বৈঠক করে নারীদের বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করে তুলছেন।
ইতিমধ্যে পাহাড়ের মানুষের কাছে বাঘাইছড়ি তথ্যকেন্দ্রটি অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত গ্রামীণ নারীদের কাছে ভরসাস্থল হয়ে উঠছে। পাহাড়ের নারীরা তাঁদের যেকোনো সমস্যা তথ্যকেন্দ্রের তথ্য আপার কাছে অনুভূতি প্রকাশ করছেপ নির্দ্বিধায়।
এ কেন্দ্রের তথ্য আপা তাঁদের সাধ্যমত সেবাগ্রহীতার সমস্যা সমাধান করে দিচ্ছেন। সুবিধা অসুবিধাগুলো উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরে পাঠিয়ে সেবা নিশ্চিত করে যাচ্ছেন । ফলে সহজেই একজন নারী কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন এ তথ্যকেন্দ্র থেকে।
সরজমিনে তথ্যকেন্দ্রের কার্যক্রম পরিচালনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম তথ্যসেবা কর্মকর্তা মুন্নি দত্তের সাথে।তিনি জানান,পাহাড়ের জনজীবন একটু ভিন্ন। জনগণের দৌঁড়গোড়ায় প্রকল্পের সেবা পৌঁছে দিতে উপজেলা সদর থেকে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় যেতে হয়।প্রথম দিকে ১৩টি উপজেলায় কার্যক্রম ছিল।তথ্যআপার কার্যক্রম সফল হওয়ার পর পুনরায় তথ্যআপা প্রকল্প( ২য় পর্যায়) এর তথ্যকেন্দ্রে যাত্রা শুরু করে ৪৯০টি উপজেলায়।
তথ্যআপাদের প্রথম দিকে ছিলো না কোন নিজস্ব অফিস।সকলের সার্বিক সহযোগিতায় আজ পুর্নাঙ্গ একটি তথ্যকেন্দ্র হয়েছে । আমাদের যাত্রা প্রথম দিকে কিছু টা কষ্ট হলেও এখন সকলের মধ্যমণি হয়ে গেছি। আমরা এলাকার মানুষের কাছে গিয়ে হৃদয়ে ছুয়ে কাজ করার সুযোগ হয়েছে ।সে দিক দিয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।
তিনি আর বলেন, পাহাড় ও গ্রামের দরিদ্র, অসহায় সুবিধাবঞ্চিত নারীদের ইন্টারনেট ব্যবহার করে চাকরির খবরা খবর, বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল, সরকারি বিভিন্ন সেবাগুলোর তথ্য সরবরাহ করা হয়। এসব সেবা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে প্রদান করা হয়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, ব্যবসা, জেন্ডার ও আইন—এই ছয়টি বিষয়ে তথ্য দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
এছাড়াও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, যেমন ব্লাড প্রেসার পরীক্ষা, ওজন পরিমাপ ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা, বিনামূল্যে চাকরি আবেদন, ভোটার আইডি কার্ড সংশোধনের জন্য অনলাইন আবেদন, বয়স্ক- বিধবা- প্রতিবন্ধী ভাতার অনলাইন আবেদন,ভিডব্লিওবি ( ভিজিডি, মাসিক ৩০কেজি চালের) অনলাইন আবেদন, সেলাই প্রশিক্ষণের অনলাইন আবেদন, বিভিন্ন শিক্ষাবৃত্তির অনলাইন আবেদন করে দেওয়া হয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য আপারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে নারীদের বিভিন্ন সমস্যা আলোচনা করে এর সমাধানের চেষ্টা করি আমরা।
জানাগেছে,তথ্য আপা প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি কাজ হলো উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে উঠান বৈঠক করে গ্রামীণ নারীদের জীবন–জীবিকা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য প্রদান করা,স্বাস্থ্যগত সমস্যা, বাল্যবিবাহ, ফতোয়া, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, ইভটেজিং চাকরি–সংক্রান্ত তথ্য, আইনি সহায়তা বিষয়ে উঠান বৈঠকগুলোতে নারীদের সচেতন করে তোলা হয়।
গত নয় মাসে কয়েক হাজার পাহাড়ি বাঙ্গালী নারীকে
বিভিন্ন সেবা প্রদান করা হয়েছে । এর মধ্যে তথ্যকেন্দ্রে সেবা প্রদান,ডোর টু ডোর সেবা দেওয়া, ভিডিও প্রদর্শনী, উঠান বৈঠক, নারীকে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করা হয়। নিয়মিত কার্যক্রমের বাইরেও এই কেন্দ্রের উদ্যোগে মহিলা অধিদপ্তরের পরিচালনায় সেলাই ও বিউটি ফিকেশন এবং তিনমাস সেলাই প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়।
এসব প্রশিক্ষণে নারীরা অংশ নিয়ে হাতে কলমে কাজ শিখে উদ্যোক্তা পারছে। পাহাড়ে নারীদের উৎপাদিত পণ্যদ্রব্য ক্রয় বিক্রয় করতে পারে তাদের জন্য রয়েছে নিজস্ব মার্কেটপ্লেস " লাল সবুজ ডট কম "।উপজেলায় নারী উদ্যোক্তা খুঁজে গত ৫ মার্চ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নিয়ে নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে উঠান বৈঠক করা হয়েছে।
শাহেরা খাতুনের মতো হাজারো নারী সেবা নিতে আসেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় মহিলা সংস্থা কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন তথ্যকেন্দ্র বাঘাইছড়ি কেন্দ্রে।
বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুমানা আক্তার জানান,সার্বিক নির্দেশনা ও মনিটরিংয়ে তথ্যকেন্দ্রের সব কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আমি নিজে উঠান বৈঠকে উপস্থিত থেকে নারীর অধিকার ও বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানের বিষয়টি আলোচনা করে আসছি।
এসময় মুন্নি দত্ত বলেন,তথ্য আপা প্রকল্প এসডিজির লক্ষ্যমাত্রায় নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর সমান ভূমিকা নিশ্চিতকরণে কাজ করছেন। গ্রামের অসহায়, দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত কিংবা কম সুবিধাপ্রাপ্ত নারীদের তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে তা তাঁদের স্বাভলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছেন তথ্য ৪৯২ টি উপজেলার তথ্যআপা পরিবার।
আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এদের অনেকেই বসবাস করেন গ্রামে। পাহাড়ে অনেক নারীকে ডিজিটালের মূলস্রোতে আনা যায়নি। তাই এসব নারীকে তথ্যপ্রযুক্তির মাঝে আনতে তথ্য আপা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন প্রকল্পের (২য় পর্যায়) কার্যক্রম চলছে। সুবিধাবঞ্চিত পাহাড়ের নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ করতে পারলে ডিজিটাল বাংলাদেশ টেকসই ও মজবুত হবে বলেই প্রকল্পসংশিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছি।
পাহাড়ে নারীর ক্ষমতায়ন করার পাশাপাশি তথ্যআপা প্রকল্প(২য় পর্যায়) এর সেবা প্রদান কার্যক্রমের সাথে জড়িত ৪৯২ টি উপজেলার ৪৯২ জন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে ৯৮৪ জন তথ্যসেবা সহকারী ও ৪৯২ জন অফিস সহায়কের সমন্বয়ে গ্রামীণ পর্যায়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে দৃঢ় প্রত্যয় রাখবে তথ্যআপা পরিবার ।