ঢাকা, শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পেতে বাধা যেখানে

অর্থনীতি ডেস্ক: | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ৩ অক্টোবর ২০২৩ ১১:৩৪:০০ পূর্বাহ্ন | অর্থনীতি ও বাণিজ্য

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত বাস্তবায়নে অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পেতে তাদের বেঁধে দেওয়া শর্ত মোতাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের লক্ষ্য পূরণ হয়নি ঠিক। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে শর্ত বাস্তবায়নে অনেক দূর এগিয়েছে সরকার। ঋণের সুদহার ও মুদ্রাবিনিময় হারে সংস্কার করা হয়েছে। তবে সমস্যা হলো, রিজার্ভের লক্ষ্য পূরণ না হওয়া। অন্যান্য ক্ষেত্রে ছাড় দিলেও আইএমএফ এ ক্ষেত্রে ছাড় দিতে চায় না। এছাড়া প্রায় প্রতিনিয়তই রিজার্ভ কমছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

 

সূত্র জানিয়েছে, আইএমএফ’র দেওয়া ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত বাস্তবায়ন ও বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আগামী ৪ অক্টোবর (বুধবার) ঢাকায় আসছে আইএমএফের একটি মিশন। এ মিশন আগামী ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে। সংস্থাগুলো হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।

 

উল্লেখ্য, আইএমএফ চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন করে। এর তিন দিন পর প্রথম কিস্তিতে ছাড় করে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। আগামী নভেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির প্রায় ৭০ কোটি ডলার ছাড় করার কথা রয়েছে। ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে তাদের দেওয়া শর্ত বাস্তবায়নের অর্থগতি পর্যবেক্ষণেই ঢাকায় আসছে আইএমএফ মিশন।

 

২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে মোট সাত কিস্তিতে পুরো অর্থ দেওয়ার কথা আইএমএফের। এই ঋণ নিতে ছোট-বড় ৩৮টি শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে।

 

শর্ত অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আগামী ডিসেম্বরে ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছে। আইএমএফের ঋণের শর্ত অনুযায়ী গত জুনের শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার থাকার কথা ছিল। জুনে নিট রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার।

 

একই সঙ্গে ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ৩ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে আইএমএফ। এ ক্ষেত্রে এনবিআর রাজস্ব আহরণ করেছে ৩ লাখ ৩১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ও রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

 

আইএমএফের ঋণের শর্ত অনুযায়ী দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভে পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছে, জ্বালানি, সার ও খাদ্যদ্রব্য আমদানির জন্য সরকারকে রিজার্ভ থেকে ডলার দিতে হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যান্য প্রতিশ্রুতি যেমন- সুদের হার নির্ধারণে করিডোর সিস্টেম চালু, আইএমএফের ব্যালান্স অব পেমেন্ট ম্যানুয়াল-৬ অনুসারে রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করা হচ্ছে। এ ছাড়া মুদ্রাবিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি কর্মপরিকল্পনা শেষ করে ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। সংস্কারমূলক কার্যক্রম আগামীতে রিজার্ভ বাড়াতে সহায়ক হবে বলেও জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

 

তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে অনেক ভালো অগ্রগতি করেছে বাংলাদেশ। শর্ত অনুযায়ী এ বছরের শুরুতেই শ্রমশক্তি জরিপেরও ত্রৈমাসিক হিসাব শুরু করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এ ছাড়াও ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপি গণনার শর্ত দিয়েছিল আইএমএফ। গত সপ্তাহে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির হিসাব প্রকাশ করতে শুরু করেছে বিবিএস। প্রথম দফায় ২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপি প্রকাশ করেছে।

 

আইএমএফের দেওয়া আরেকটি শর্ত ছিল, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগে ঝুঁকি ব্যবস্থা ইউনিট গড়ে তুলতে হবে। এই শর্ত পূরণে শুল্ক বিভাগের জন্য পৃথক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট গঠন করা হয়েছে। এ বিষযটি আইএমএফের যে মিশনটি আসছে সে মিশনটি দ্বিতীয় পর্যালোচনার সময় আলোচনায় আনবে বলে জানা গেছে।

 

আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক-কর আদায় করার কথা বলা হয়েছিল। যা প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার সমান। চলতি অর্থবছরের মধ্যে এনবিআরকে এ জন্য একটি মধ্যমেয়াদি রাজস্ব-কৌশল ঠিক করতে হবে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এ জন্য এনবিআরের সদস্য শামসুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এনবিআর প্রচেষ্টানির্ভর কৌশলে রাজস্ব আদায় বাড়াতে চাইলেও আইএমএফ চায়, অটোমেশনের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো হোক। এছাড়া যেসব খাত থেকে বেশি রাজস্ব আসে, সেখানে বেশি জোর দেওয়া। এসব বিষয় মিশনের সঙ্গে আলোচনা হবে বলেও জানা গেছে।

 

সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) ও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) লোকসানের তথ্য চাওয়া হয়েছে আইএমএফ’র পক্ষ থেকে। এই তিন সংস্থাকে বাজেট থেকে কী ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে সেটি জানতে চাওয়া হয়। এছাড়া বিদেশি ঋণ, জ্বালানি আমদানি ব্যয়, করোনা পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার পদক্ষেপ নিয়ে আবারও আলোচনা হতে পারে বলে জানা গেছে।

 

আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী জুনের আগে ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়াটি বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপনের শর্ত ছিল। ইতোমধ্যে খসড়াটি মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত অনুমোদন শেষে বিল আকারে সংসদে উত্থাপনের পরে তা পাসও করা হয়েছে।

 

তবে রিজার্ভ ধরে রাখা এবং রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হওয়াটাকে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়ার ক্ষেত্রে অকেটাই জটিল সমস্য মনে করছেন দেশের অর্থনৈতিক খাতের বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন,  আইএমএফ অন্যান্য ক্ষেত্রে ছাড় দিলেও এ দুটি ক্ষেত্রে ছাড় দিতে চায় না। রিজার্ভ ধরে রাখা ও রাজস্ব আহরণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা উচিত ছিল বলে মনে করেন সরকারের সাবেক অর্থ সচিব ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাবেক বিকল্প নির্বাহী পরিচালক মাহবুব আহমেদ ও বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। 

 

এ প্রসঙ্গে ড. জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, বাংলাদেশের আরেকটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ে নতুন ফর্মুলা চূড়ান্ত করতে না পারাটা। পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, তাই ফর্মুলা বাস্তবায়ন হচ্ছে না-  এমন যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় আইএমএফের কাছে। এটার পরিবর্তন জরুরি।

 

জানতে চাইলে অর্থ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাবেক বিকল্প নির্বাহী পরিচালক ড. মাহবুব আহমেদ জানিয়েছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশ খানিকটা পিছিয়ে রয়েছে। এটি ফুলফিল করতে পারলে দ্বিতীয় কিস্তর ঋণের অর্থ পেতে কোনও সংশয়ই থাকতো না।