ঢাকা, রবিবার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১
পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন মোড়!

ইমরানকে কি জেলে আটকে রাখা সম্ভব?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: | প্রকাশের সময় : সোমবার ১৪ অগাস্ট ২০২৩ ০১:১১:০০ পূর্বাহ্ন | আন্তর্জাতিক

দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিশেষ করে তিনি আগামী নির্বাচনে লড়তে পারবেন কিনা, কবে ছাড়া পাবেন কিংবা কী হবে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ- এমন বিষয়গুলোই ঘুরেফিরে আসছে আলোচনায়।

 

এর মধ্যেই জাতীয় পরিষদ বিলুপ্তের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আনোয়ারুল হক কাকারকে পেয়েছে পাকিস্তান। আর ‘নিরপেক্ষ প্রার্থী’ হিসেবে কাকারের এই নিয়োগকেই ইমরানের ভাগ্যে ‘আশার আলো’ হিসেবে দেখছেন অনেকে। কিন্তু কীভাবে?

তোশাখানা দুর্নীতি মামলায় গত ৫ আগস্ট পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী দল তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খানকে ৩ বছর কারাদণ্ডের রায় দেন আদালত। তাকে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ থেকে ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধও করা হয়। একইদিনে তিনি গ্রেফতার হন। 

 

 

আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে ৮ আগস্ট ইসলামাবাদ হাইকোর্টে আপিল আবেদন করার কথা জানান ইমরানের আইজীবী নাইম হায়দার পাঞ্জোথা। নিয়ম অনুযায়ী, উচ্চ আদালত আপিল আবেদন অনুমোদন করলে মামলাটি নতুন করে শুনানির জন্য নির্ধারিত হবে। শুনানির মাধ্যমে জেলা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ইমরানের আইনজীবী যেসব পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন, তা নিয়ে শুরু হবে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। 

 

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইমরান খানের বিরুদ্ধে চলমান মামলার সুরাহা হতে পার হবে মাসের পর মাস। ফলে আসন্ন নির্বাচনে তার অংশগ্রহণের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে দেশের সংবিধান টিকে থাকলে ইমরানের রাজনীতিও হয়তো টিকে যাবে, আর এর লঙ্ঘন হলে সমাপ্তি এখানেই। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আনোয়ারুল হক কাকারকে বেছে নেয়ায় স্বস্তিতে আছে সব পক্ষই। নিরপেক্ষ প্রার্থী হিসেবে মেনে নিয়ে তাকে স্বাগত জানিয়েছে ইমরান খানের দল পিটিআইও। কারণ, একসময় পিটিআইয়ের হয়েও কাজ করেছেন কাকার। ফলে দলটির অনেকে মনে করছেন, এতে কিছুটা হলেও ‘সুবিধা’ পাবেন ইমরান।  

 

কিন্তু বিষয়টি কি আসলেই এত সহজ? পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায়, ইমরানকে বাড়তি কোনো সুবিধা দেয়া প্রায় অসম্ভব কাকারের পক্ষে। বরং নিজেকে তার নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে হবে বহু ‘চাপ’ মোকাবিলা করেই। কারণ, শুধুমাত্র শাহবাজ শরিফ ও জাতীয় পরিষদের বিরোধী নেতা রাজা রিয়াজই নয়, কাকারের সামনে রয়েছে পাকিস্তানের প্রভাবশালী সামরিক বাহিনীর চ্যালেঞ্জও। এমনকি গুঞ্জন রয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর জন্যও তাকে ‘সহায়ক ভূমিকা’ পালন করতে বলা হতে পারে। 

 

কী আছে তাহলে ইমরানের ভাগ্যে? 

সম্প্রতি এক কলামে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন সিনিয়র পাকিস্তানি সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামিদ মীর। তিনি লিখেছেন, ‘ইমরান খান গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি মনে করি, পাকিস্তানের সংবিধান একজন ব্যক্তির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং বর্তমানে সংবিধানই ইমরান খানের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।’ 

 

 

ইমরান খান পাকিস্তানে গ্রেফতার হওয়া প্রথম প্রধানমন্ত্রী নন। আইয়ুব খানের আমলে ১৯৬২ সালে রাষ্ট্রদোহের অভিযোগে গ্রেফতার হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়া-উল-হকের আমলে হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার হন জুলফিকার আলী ভুট্টো। বেনজির ভুট্টো বহুবার গ্রেফতার হয়েছেন, নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় থাকাকালে দুর্নীতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন। এছাড়া ২০১৮ সালে নওয়াজ শরিফ এবং শহিদ খাকান আব্বাসিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইমরান খান। 

 

কিন্তু ইমরান খানের চেয়ে সংবিধান কেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ? হামিদ মীরের মতে, পাকিস্তানের সংবিধান টিকে থাকলে ইমরান খানও বেঁচে যেতে পারেন, কিন্তু তা লঙ্ঘন করা হলে রাজনৈতিকভাবে তার টিকে থাকা বেশ কঠিন হবে। 

 

সংবিধানের সঙ্গে ইমরান খানের টিকে থাকার সম্পর্ক কী? পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ তার মেয়াদ পূর্ণ করেছে। ফলে তিন মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন এখন সাংবিধানিক দাবি। আর যদি তা হয় অর্থাৎ এই বছরের নভেম্বরের মধ্যে যদি পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হয়, তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি পাবেন না ইমরান খান। কারণ, দুর্নীতির অভিযোগে নিম্ন আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর, ইমরান খানকে ৫ বছরের জন্য নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছে দেশটির নির্বাচন কমিশন।

 

ইমরানের বিরুদ্ধে ইসলামাবাদের জেলা আদালতের রায়কে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট সেই আবেদন গ্রহণ করেছেন। যদিও ইমরানের ছাড়া পাওয়ার বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে তার নিজের আইনজীবীদের মধ্যেই। 

 

তবে ইমরান খান যদি দুর্নীতির মামলায় সুপ্রিম কোর্ট থেকে পরিত্রাণ পানও, এরপরও বিভিন্ন বেসামরিক আদালতে তার বিরুদ্ধে ১৮০টিরও বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে এবং সবশেষে একটি সামরিক আদালতও তার জন্য অপেক্ষা করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে ইমরানকে নতুন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত রাখতে। তবে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে না দেয়া হলেও, রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকতে পারবেন ইমরান খান। 

 

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় নওয়াজ শরিফের কথা। তিনবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তিনি। কিন্তু প্রতিবারই মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই তাকে সরকার থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালে ইমরান খানের এক আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট নওয়াজকে অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে বহু মামলা ছিল এবং অবশেষে ২০১৮ সালের নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে তাকে গ্রেফতারও করা হয়। এসময় নওয়াজ শরিফের দলের অনেক নেতা ইমরান খানের দলে যোগ দিতে বাধ্য হন।

 

এমনকি, নওয়াজ শরিফের মেয়ে মরিয়ম নওয়াজ তার বাবাকে কারাগারে দেখতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, জেলে নওয়াজ শরীফকে নির্যাতন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন ইমরান খান। তাকে তার অসুস্থ স্ত্রী কুলসুম নওয়াজের সঙ্গে ফোনে কথাও বলতে দেয়া হয়নি। স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে তার সঙ্গে ফোনে কথা বলার জন্য অনুরোধ করেছিলেন নওয়াজ শরিফ।

 

দোষী সাব্যস্ত ও অযোগ্যতা সত্ত্বেও নওয়াজ শরিফ বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি আসিফ আলী জারদারির সঙ্গে জোট করে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ২০২২ সালে তার ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী হন। মূলত, নওয়াজ শরিফই পাকিস্তানের বাইরে বসে জেনারেল আসিম মুনিরকে দেশের নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ‘সিদ্ধান্ত’ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়, যিনি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নওয়াজের দলকে ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করেন।

 

শাহবাজ শরিফ এখন দাবি করছেন, নওয়াজ শরিফ চতুর্থবারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। এমন সমীকরণের উদাহরণ টেনে অনেকে তাই বলছেন, দোষী সাব্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও নওয়াজ শরিফ যদি টিকে থাকতে পারেন, তাহলে ইমরান খানও টিকে যাবেন।

 

ইমরান কি জনসমর্থন হারাচ্ছেন?

প্রথম দফায় গত ৯ মে ইমরান খানকে গ্রেফতারের পর পাকিস্তানজুড়ে বিক্ষোভ-সহিংসতা শুরু হয়। কিন্তু ৫ আগস্ট তাকে দ্বিতীয়বার গ্রেফতারের পর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তাহলে ইমরান কি জনসমর্থন হারাচ্ছেন? উত্তর হলো ‘না’। ইমরান খানের বিরোধীরা খুব ভালো করেই জানে যে তার দল (পিটিআই) ভেঙে গেলেও, ভোটব্যাংক এখনও অটুট রয়েছে। যার প্রমাণ মিলেছে গত ৬ আগস্ট পেশোয়ারের উপনির্বাচনে পিটিআইয়ের জয়ের মধ্য দিয়ে। 

 

 

আগে এই আসনে ইমরান খান হেরে গেলেও এখন তার ভোট বেড়েছে চারগুণ। ইমরানের নির্বাচনী প্রতীক ক্রিকেট ব্যাট। আর এই ব্যাট এখনও বাঘ (নওয়াজ শরিফের নির্বাচনী প্রতীক) এবং তীরের (জারদারির নির্বাচনী প্রতীক) জন্য বড় হুমকি। 

 

পিটিআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মেহমুদ কুরেশি বহুবার আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন যে, কিছু ‘শক্তি’ পিটিআইকে নিষিদ্ধ করতে চায়, কারণ ইমরান খানের ভোটব্যাংক এখনও অক্ষত রয়েছে। জনগণের কাছেও তিনি এখনও সমান জনপ্রিয়। 

 

নিষিদ্ধ হবে পিটিআই! 

পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট কি একটি মূলধারার রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার অনুমতি দেবে? পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে তার মেয়াদ শেষ করবেন। পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হবেন কাজী ফয়েজ ঈসা, যিনি ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ‘অযোগ্য’ তকমা পেয়েছিলেন। 

 

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামিদ মীরের মতে, কাজী ফয়েজ ঈসা প্রতিশোধ নেবেন না। তিনি সংবিধান অনুযায়ী কাজ করতে পারেন। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট যদি সংবিধান রক্ষা করে, তাহলে পিটিআইকে নিষিদ্ধ করা কঠিন হবে। 

 

 

ইমরান বিরোধীদের সামনে আর কী পথ বাকি?

কোনো কিছুতে ইমরানকে আটকাতে না পারলে, তার বিরোধীরা নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করবে। তবে নির্বাচনে কোনো বিলম্ব হলে তা হবে পাকিস্তানের সংবিধানের ওপর হামলার সামিল। কারণ, নির্বাচনের বিলম্ব তখন সংবিধান স্থগিতের চেয়ে কম নয় বলেই বিবেচিত হবে। 

 

যদিও ক্ষমতায় থাকাকালীন ইমরান খান কখনোই এই সংবিধানকে পাত্তা দেননি। তিনি গোয়েন্দা সংস্থাকে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে উৎসাহিত করেছেন। কিন্তু এখন তার নিজের টিকে থাকাটাই হুমকির মুখে। একমাত্র সংবিধানের আধিপত্যই তাকে এবং তার দলকে বাঁচাতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।