রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে সারের দাম। যে কারণে চলতি ও আগামী বাজেটে কৃষিখাতের ব্যয় নিয়ে বাড়তি চাপ অনুভব করছে সরকার। বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় সম্প্রতি সংশোধিত চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটেই কৃষিখাতের বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ২ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা।
বিপুল অঙ্কের এই অর্থের বড় অংশই চলে যাবে সার কেনার বর্ধিত মূল্য পরিশোধে। এমন পরিস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সারের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু দাম বাড়াতে রাজি হয়নি সরকার।
আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটেও কৃষির বাজেট, বিশেষ করে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ নিয়ে চাপে আছে সরকার।
জানা গেছে, যে কোনও মূল্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে— এমন নীতিতেই চলছে সরকার। না হয় খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছে নীতিনির্ধারণী মহল।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে— এমনটা অনুমান করেই চলতি অর্থবছরের শুরুতে কৃষিতে ভর্তুকি বাবদ সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু অর্থবছরের শেষ দিকে এসে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম।
সার ছাড়াও কৃষিপণ্য ও সেবা-ক্রয় খাতে এ বছর ব্যয় বেড়েছে। ফলে শেষ দিকে এসে ইউরিয়া সার প্রতিকেজির মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে ৩২ টাকা থেকে বেড়ে ৯৬ টাকায় দাঁড়ায়। টিএসপি ৩৩ টাকা থেকে বেড়ে ৭০ টাকা, এমওপি ২৩ টাকা থেকে বেড়ে ৫৪ টাকা এবং ডিএপি সারের দাম ৩৭ টাকা থেকে বেড়ে ৯৩ টাকায় ওঠে।
সরকার বিশ্ববাজার থেকে বেশি দাম দিয়ে আমদানি করলেও দেশে কোনও সারের দামই বাড়ায়নি। ফলে এ খাতে বড় ধরনের ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। সংশোধিত বাজেটে কৃষিতে ভর্তুকি আড়াই হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ১২ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়।
জানা গেছে, নতুন অর্থবছরের জন্য কৃষিতে ৩০ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকির প্রয়োজন হবে। কৃষি যন্ত্রপাতি বাবদ ভর্তুকি আরও বাড়বে বলে আভাস দিয়েছে কৃষি ও অর্থ মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, আগামী বছর কৃষিখাতে বিশেষ করে সারসহ কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দের পরিমাণ না বাড়ানোর বিকল্প নেই। সারের দাম বাড়াতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব সরকার নাকচ করে দিয়েছে।
মন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, বড় কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে দেশে খাদ্য সংকটের সুযোগ নেই। এই মুহূর্তে মাঠে ধানের অবস্থা ভালো। এ বছর লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৯০ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। হাওরে ৪ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় সাত হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সময়মতো বাঁধ রক্ষা, অনুকূল আবহাওয়া ও যন্ত্রের মাধ্যমে দ্রুত ধান কাটার ফলে ইতোমধ্যে হাওরের ধান ঘরে তোলা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে ব্যয় কমাতে হবে। এছাড়া, কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রেখে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বাজেটে পরিচালনা ব্যয়ের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়কে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৩ হাজার ১৭১ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন খাতে ৩ হাজার ৩০ কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে আরও ২ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এতে পরিচালনা খাতের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। পাশাপাশি উন্নয়ন খাতে ১৬৬ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৩ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিচালনা ও উন্নয়ন খাতে শুরুতে বরাদ্দ ছিল ১৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। সেটি সংশোধিত বাজেটে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। এতে মোট ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, এ বছর মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪ কোটি ৬৫ লাখ ৮২ হাজার মেট্রিক টন।
সর্বশেষ তথ্যমতে এবার ফসলের মোট উৎপাদন হবে ৪ কোটি ৭১ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টন বেশি।
এর মধ্যে আমনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দেড় কোটি মেট্রিক টন। সেখানে আমন পাওয়া যাবে ১ কোটি ৫৬ লাখ মেট্রিক টন।
আউস পাওয়া যাবে ৩৪ লাখ ৫২ হাজার টন, বোরো ২ কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার টন, গম ১২ লাখ ২৬ হাজার টন ও ভুট্টা ৫৮ লাখ ৭৫ হাজার টন।