ঢাকা, রবিবার ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১

খাদ্য দিয়ে ফিতরা আদায়-সুন্নত

মমিনুল ইসলাম মোল্লা,মুরাদনগর : | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ১৮ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:৫৩:০০ পূর্বাহ্ন | ধর্ম

রমযান মাসের সিয়ামের ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষতি পূরণার্থে এবং অভাবগ্রস্তদের খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে ঈদের স্বলাতের পূর্বে নির্ধারিত পরিমানের যে খাদ্য সামগ্রী দান করা হয়ে থাকে- শরীয়াতের পরিভাষায় তাকেই যাকাতুল ফিত্ র বা ফিত্‌রা বলা হয়ে থাকে। ফিত্‌রা দেয়া ওয়াজিব। প্রত্যেক মুসলিম নারী-পুরুষছোট-বড়স্বাধীন-পরাধীনধনী-গরীব সকলের উপর ফিত্‌রা দেয়া ওয়াজিব।

 

          ঈদের দিন যদি কোন মুসলিম ব্যক্তি ও তার পরিবারবর্গের প্রয়োজনীয় খাবারের চেয়ে অতিরিক্ত আরো ২ কেজি ৪০ গ্রাম পরিমাণ নির্দিষ্ট খাবার মওজুদ থাকে তাহলে ঐ ব্যক্তি ও তার পরিবারবর্গের সকল সদস্যদের উপর ফিত্‌রা প্রদান ফরয হয়ে যাবে।

(ক) আবদুল্লাহ ইবনে 'উমার রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ () স্বাধীনকৃতদাসনারীপুরুষছোটবড় প্রত্যেক মুসলিমের প্রতি রমাযানের সিয়ামের কারণে এক সা'আ খেজুর বা এক সা'আ যব ফিত্‌রা হিসেবে ফরয করে দিয়েছেন। (বুখারী ও মুসলিম)

(খ) আহমাদের একটি বিশুদ্ধ হাদীসে আবূ হুরাইরাহ রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে,

فِيْ زَكَاةِ الْفِطْرِ عَلَى كُلِّ حَرٍّ وَعَبْدٍ ذَكَرٍ وَأُنْثَى صَغِيْرٍ أَوْ كَبِيْرٍ فَقِيْرٍ أَوْ غَنِىٍّ صَاعًا مِنْ تَمَرٍ

প্রত্যেক স্বাধীনপরাধীননারীপুরুষ ছোটবড়ফকীর-ধনীপ্রত্যেকের উপর জনপ্রতি এক সা'আ (২ কেজি ৪০ গ্রাম) পরিমাণ খেজুর ফিত্‌রা হিসেবে দান করা ওয়াজিব। যে দরিদ্র ব্যক্তি ফিত্‌রা গ্রহণ করবে সেও কি তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের ফিত্‌রা প্রদান করবে?  নাদিবে না। যারা যাকাত খেতে পারে তাদেরকেই ফিত্‌রা দেবেন। একাধিক লোকের ফিত্‌রা কি একজন দরিদ্রকে দেয়া জায়েয । অপরদিকে এক ব্যক্তির ফিত্‌রা ভাগ করে একাধিক লোককে দেয়াও জায়েয আছে।

 

ফিত্‌রা হিসেবে যে ধরনের খাদ্য দ্রব্য দেয়ার বিধান আছে -  গমভুট্টাযবখেজুরকিসমিসপনিরআটাচাউল ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য। প্রতি একজনের উপর এক সা'আ পরিমাণপরিমাণ ফিত্‌রা দেয়া ফরয

আলেমদের মতে সা'আর সমপরিমাণ হল ২ কেজি ৪০ গ্রাম। (ক) রাসূল () এর সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী রাদিআল্লাহু আনহু বলেছেন যে,

كُنَّا نُخْرِجُ زَكَاةَ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيْرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ تَمَرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ أقط أَوْ صَاعًا مِنْ زَبِيْبٍ

আমরা ফিত্‌রা দিতাম মাথাপিছু এক সা'আ পরিমাণ খাদ্য বা এক সা'আ যব বা এক সা'আ খেজুর বা এক সা'আ পনির বা এক সা'আ কিসমিস। (বুখারী ও মুসলিম) (খ) নাসাঈর অন্য এক হাদীসে আছে

صَدَقَةُ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ

ফিত্‌রা হচ্ছে এক সা'আ পরিমাণ খাদ্যবস্তু।

 

: মালিকীশাফেয়ীও হাম্বালী এ তিন মাযহাবের ইমামগণ বলেছেনযেহেতু হাদীসে খাদ্য দ্রব্য দান করতে বলা হয়েছে সেহেতু টাকা পয়সা দিয়ে ফিত্‌রা দিলে তা জায়েয হবে না। কিন্তু কিয়াসের আলোকে হানাফী মাযহাবে টাকা পয়সা দিয়ে ফিত্‌রা দেয়াকে জায়েয বলেছেন। বিবেকের বিশ্লষণে আপনি যে কোন একটা মত গ্রহণ করতে পারেন ফিত্‌রা দেয়ার দু'টি সয়য় আছে : একটি হল উত্তম সময়অন্যটি হল বৈধ সময়। উত্তম সময় হল ঈদের দিন ঈদের স্বলাত আদায় করার পূর্বে ফিত্‌রা প্রদান শেষ করা। আর জায়েয সময় হল ঈদের দু'এক দিন আগেই ফিত্‌রা প্রদান করে ফেলা। ইবনু 'উমার বলেছেন,

أَنَّ النَّبْيَّ -صلى الله عليه وسلم- أَمَرَ بِزَكَاةِ الْفِطْرِ قَبْلَ خُرُوْجِ النَّاسِ إِلَى الصَّلاَةِ

নাবী () লোকদের ঈদের স্বলাত আদায় করার আগেই ফিত্‌রা দিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। (মুসলিম) । ঈদের আগের দিন সূর্যাস্তের পর থেকে ফিত্‌রা প্রদানের ফরয সময় কখন শুরু হয় 

 

স্বলাত আদায়ের পূর্বে হলে তা ফিৎরা হিসেবে গণ্য হবে। আর স্বলাতের পর হলে তা হবে সাধারণ দান। আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস বর্ণিত হাদীসে রাসূল () বলেছেন,

زَكَاةُ الْفِطْرِ طُهْرَةٌ لِلصَّائِمِ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ وَطَعْمِهِ لِلْمَسَاكِيْنَ - فَمَنْ أَدَّاهَا قَبْلَ الصَّلاَةِ فَهِيَ زَكَاةٌ مَقْبُوْلَةٌ وَمَنْ أَدَّاهَا بَعْدَ الصَّلاَةِ فَهِيَ صَدَقَةٌ مِنْ صَدَقَاتٍ

সিয়াম পালনকারীর অপ্রয়োজনীয় ও বেফাস কথাবার্তা থেকে তাকে পবিত্রকরণ এবং গরীব মিসকীনদের খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে রাসূল () ফিত্‌রা প্রদান করাকে ফরয করে দিয়েছেন। অতএব যে ব্যক্তি ঈদের স্বলাতের আগে তা পরিশোধ করবে সেটা ফিত্‌রা হিসেবে আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে। আর ঈদের স্বলাতের পর দিলে তা হবে একটা সাধারণ দান খয়রাত। (অর্থাৎ তা ফিত্‌রা হিসেবে গণ্য হবে না)। (আবূ দাউদইবনে মাজাহ)

 

ঈদের দিন সূর্যোদয়ের আগে কোন শিশু জন্ম গ্রহণ করলে তার ফিত্‌রা দেয়া লাগবে

। তবে সেদিন সূর্যোদয়ের পর ভূমিষ্ট হলে ফিত্‌রা দেয়া লাগবে না। তবে দিয়ে দিলে সাওয়াব হবে। অনুরূপভাবে ঈদের আগের দিন সূর্যাস্তের পূর্বে কেউ ইন্তেকাল করলে তার ফিত্‌রা দিতে হবে না। কিন্তু সেদিন সূর্যাস্তের পর মারা গেলে তার পক্ষে ফিত্‌রা দিতে হবে। কারণ ফিত্‌রা প্রদানের ফরয সময় শুরু হয় ঈদের আগের দিন সূর্যাস্তের পর থেকে

কেজির ওজনে তা আড়াই কিলোর কম নয়।

 

▪ইবনে উমার (রাযি:) হতে বর্ণিত হয়েছেতিনি বলেন:

‘‘ আল্লাহর রাসূল যাকাতুল ফিতর স্বরূপ এক ’সা কিংবা এক ’সা যব ফরয করেছেন মুসলিম দাসস্বাধীন ব্যক্তিপুরুষ ও নারী এবং ছোট ও বড়র প্রতি। আর তা লোকদের নামাযে বের হওয়ার পূর্বে আদায় করে দিতে আদেশ করেছেন” [ বুখারীঅধ্যায়: যাকাত হাদীস নং ১৫০৩/ মুসলিম নং ২২৭৫] উক্ত হাদীসে দুটি খাদ্য দ্রব্যের নাম পাওয়া গেল যাদ্বারা নবীর যুগে ফিতরা দেওয়া হত। একটি হচ্ছে খেজুর অপরটি যব। এবার নিম্নে আর একটি হাদীস পাঠ করুন। আবু সাঈদ খুদরী (রাযি:) বলেন :‘‘আমরা-নবীজীর যুগে যাকাতুল ফিতর বের করতাম এক শ্বা খাদ্য দ্রব্য কিংবা এক সা’ যব কিংবা এক সা’ খেজুর কিংবা এক সা’ পনীর কিংবা এক শ্বা কিশমিশ’’ [ বুখারী- ১৫০৬ মুসলিম-২২৮১] এই হাদীসে খেজুর ও যব ছাড়া আরও যে কয়েকটি বস্তুর নাম পাওয়া গেল তা হল : কিশমিশপনীর এবং খাদ্য দ্রব্য। উল্লেখ থাকে যেনবীজীর মৃত্যুর পর মুয়াবিয়া (রাযি:) এর খেলাফত কালে অনেকে গম দ্বারা ফিতরা দিতেন। [ বুখারী হাদীস নং ১৫০৮ মুসলিম ২২৮১ ]

তাই আমরা যদি সুন্নত অনুসরণ করতে চাই তাহলে আমাদের সমাজের প্রচলিত প্রধান খাদ্যদ্রব্য তথা চাল দ্বারা ফিতরা দেয়া কর্তব্য। ফিতরার মুল্য দ্বারা অথবা সেটাকা দিয়ে পোশাকচিনিতেলমসলাশেমাইগোস্ত ইত্যাদি কিনে দেয়া সুন্নত পরিপন্থী।তবে একান্ত জরুরি অবস্থায় টাকা দ্বারা ফিতরা দেয়া যেতে পারে বলেঅনেক আলেম মন্তব্য করেছেন। যেমনরোগীর চিকিৎসার জন্য জন্য এই মুর্হতে টাকা প্রয়োজন। চাল দিলে সেটা বিক্রয় করে টাকা সংগ্রহ করতে গেলে রোগীর সমস্যা বেড়ে যেতে পারে...বা এ জাতীয় পরিস্থিতে ফিতরার মূল্য দিলেও আদায় হয়ে যাবে। কারণ এখানে বিশেষ পরিস্থিতে মুল্য দ্বারা ফিতরা প্রদান করা হয়েছে।

সুতরাং আমাদের কতর্ব্য খাদ্যদ্রব্য দেয়া। কেউ যদি তা নিতে না চায় তাহলে এমন ব্যক্তিকে দেয়া উচিৎ যে তা গ্রহণ করবে।

লেখক: মমিনুল ইসলাম মোল্লা,ইসলামী চিন্তাবিদ, সাংবাদিক ও কলামিস্ট. কুমিল্লা 01711713257