দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হওয়ার কথা। সেই হিসাবে নির্বাচনের তফসিল হতে পারে নভেম্বরে। এই রোডম্যাপ সামনে রেখে নির্বাচনি পরিকল্পনা সাজাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এরই অংশ হিসেবে চলতি মাস সেপ্টেম্বর থেকেই গণসংযোগে নামছে দলটি। এবারের নির্বাচনি প্রচারণায় সরকারের তিন মেয়াদে খাতভিত্তিক উন্নয়ন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অর্জন এবং ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে খাতভিত্তিক পরিকল্পনা সামনে আনা হবে। এসব বিষয় প্রাধান্য দিয়ে প্রণয়ন করা হচ্ছে নির্বাচনি ইশতেহারও। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি পরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত একাধিক নেতা এমনটা জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, বিএনপি নির্বাচনে আসবে কিনা, সেটি নিয়ে ধোঁয়াশায় থাকায় নির্বাচনি গণসংযোগের ক্ষেত্রে দুই ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি ভোটে আসলে তাদের আমলের নানা ‘অপকর্ম’ নির্বাচনি প্রচারে বেশি গুরুত্ব দিবে ক্ষমতাসীনরা। আর বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না আসলে এই সরকারের উন্নয়নের চিত্র প্রচারে বেশি গুরুত্ব পাবে। এই দুইটি দিক সামনে রেখেই সেপ্টেম্বর থেকে নির্বাচনি প্রচারণা বা গণসংযোগ চলবে। তবে নভেম্বরে চূড়ান্ত হবে আওয়ামী লীগের পুরো নির্বাচনি পরিকল্পনা।
বিএনপি ও তাদের যুগপৎ সঙ্গীদের সরকারবিরোধী আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় রাজপথে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, এ কারণে শান্তি সমাবেশের সঙ্গে ‘উন্নয়ন’ যুক্ত করে সমাবেশগুলো করা হচ্ছে, যাতে নির্বাচনি আমেজও তৈরি হয়। কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতাদের তিন মাস আগেই নির্বাচনি এলাকায় গণসংযোগ চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ‘আত্মপ্রচারের’ চেয়ে সরকারের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং বিএনপি আমলের নেতিবাচক দিকগুলো বেশি প্রচার করতে বলা হয়েছে। এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল সামনে রেখে গণসংযোগে গতি বাড়ানোর তাগিদ এসেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্তত তিন জন সদস্য বলেছেন, সভা-সমাবেশ ছাড়া কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা তেমন কোনও কাজ করছেন না। পোস্টার-বিলবোর্ড, তোরণ তৈরি আর ফেসবুকে প্রচারণা চালাচ্ছেন তারা। এসব প্রচারণায় নিজেকে জাহির করতেই ব্যস্ত সবাই। সরকারের উন্নয়ন খুব একটা প্রচারে আসছে না। এতে আত্মপ্রচার হলেও দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সে কারণে চলতি সেপ্টেম্বর মাস থেকেই গত ১৫ বছরে সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রগতি এবং আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রচারে নামার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আর অক্টোবর মাস থেকে নির্বাচনকেন্দ্রিক জনসভাও শুরু করবে ক্ষমতাসীন দলটি।
সবশেষ শুক্রবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভায় নেতাদের নির্বাচনে প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেন দলীয় প্রধান। সভাসূত্র জানায়, দলের সভাপতি শেখ হাসিনা তাদের বলেছেন, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আগামী নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং একইসঙ্গে চ্যালেঞ্জিংও বটে। এখন থেকেই নির্বাচনি প্রস্তুতি ত্বরান্বিত করতে হবে। সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রগতি তুলে ধরে দেশের জনগণকে নির্বাচনের ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে হবে। নির্বাচনি প্রচারে সবাইকে মনোযোগ দিতে হবে, আর যাকে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হবে তার পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে সবাইকে কাজ করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আমাদের নির্বাচনি গণসংযোগ ইতোমধ্যে পুরোদমে শুরু হয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনের সময় সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষণ দিচ্ছেন। শান্তি সমাবেশে উন্নয়ন যুক্ত হয়েছে। সমাবেশের সংখ্যাও আগের চেয়ে বেড়েছে। নির্বাচনি কার্যক্রমও গতি পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সফর শেষে দেশে আসার পর নির্বাচনি জনসভা আরও বাড়বে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে যোগ দিতে রবিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ৪ অক্টোবর তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে। এই সফর থেকে ফেরার পথে তিন দিন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করবেন তিনি।
আওয়ামী লীগের দুই জন সাংগঠনিক সম্পাদক জানিয়েছেন, অক্টোবর থেকে নির্বাচনি জনসভা করবে আওয়ামী লীগ। নভেম্বরে তফসিল ঘোষণার পর জেলায় জেলায় জনসভা করা হবে। এ ছাড়া সুধী সমাবেশ তো আছেই। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি জনসভা বাড়তে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন তারা।
গত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলটির সম্পাদকমণ্ডলীর সঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ শাখা এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের একটি যৌথসভা হয়। সেখানে শোকের মাস আগস্ট শেষ হলে সেপ্টেম্বর থেকেই নির্বাচনি গণসংযোগে নামার নির্দেশনা দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। যেকোনও মিছিল, সমাবেশ ও শোভাযাত্রা ও জনসভায় সরকারের উন্নয়ন, সাফল্য ও প্রধানমন্ত্রীর অর্জন তুলে ধরার কথা বলা হয়।
নির্বাচনি প্রচারে নামার কথা বলা হলেও তৃণমূলে নির্বাচনি প্রস্তুতি নিয়ে আওয়ামী লীগে এখনও অস্বস্তি রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্তত দুই জন সদস্য বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন, মনোনয়নপ্রত্যাশীসহ নেতাদের বেশিরভাগই রাজধানীতে থাকেন। এলাকায় তারা কম যান, এ কারণে তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ তুলনামূলক কিছুটা কম হচ্ছে। আবার কে মনোনয়ন পাবেন, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। উপ-নির্বাচনগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, এক একটি আসনে ১৫-২০ জন মনোনয়ন প্রত্যাশী ফরম সংগ্রহ করছেন। কোথাও এই সংখ্যা ২৫-৩০ এও গিয়ে ঠেকেছে। তারা যদি এলাকায় গিয়ে গণসংযোগ করতো, তাহলে মাঠের চিত্র ভিন্ন দেখা দেখা যেতো। এ বিষয়টি দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাকে এরইমধ্যে অবহিত করা হয়েছে। হয়তো শিগগিরই এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আসতে পারে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আমরা নির্বাচনি প্রচারণার মধ্যেই রয়েছি। আর বিএনপি নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করে যাচ্ছে। সে কারণে শান্তি সমাবেশগুলোতে এখন ‘উন্নয়ন ও শান্তি সমাবেশ’ নামে পালন করা হচ্ছে। এতে সরকারের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরে জনগণকে আস্থায় আনার চেষ্টা চলছে। তবে তফসিল ঘোষণার সময় ঘনিয়ে আসায় সেপ্টেম্বর মাস থেকে গণসংযোগ বাড়ানো হবে। তফসিল ঘোষণার পর পুরোদমে চলবে এই কার্যক্রম। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত দিনতে দিন গণসংযোগের গতি বাড়ানো হবে।