ঢাকা, রবিবার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

চাহিদার চেয়ে জোগান বেশি, এরপরও বাড়ছে পেঁয়াজের দাম

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : বুধবার ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ০১:৫৫:০০ পূর্বাহ্ন | অর্থনীতি ও বাণিজ্য

হুট করে ভারতের রপ্তানি বন্ধের খবরে দেশের বাজারে হু হু করে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। যদিও ভারতের রপ্তানি বন্ধের পরে এখনো বাজারে পেঁয়াজের কোনো সংকট হয়নি। বরং গত কয়েকদিনে দেশি নতুন মুড়িকাটা ও গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের সরবরাহ বেশ ভালো। একই সঙ্গে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে পাতাসহ পেঁয়াজ। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যের কোনো সংকট থাকার কথা নয় এখন। অথচ কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে মাত্র দুদিনের মধ্যে পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এজন্য কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

 

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৮ লাখ টন। অর্থাৎ প্রতি মাসে দরকার হয় গড়ে ২ লাখ ৩৩ হাজার টন। চলতি মৌসুমে দেশে মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে, যার উৎপাদন হবে প্রায় ৮ লাখ টন। এসব পেঁয়াজ এখন বাজারে আসতে শুরু করেছে। এখন থেকে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস পর্যন্ত ওই পেঁয়াজের মাধ্যমে জোগান ঠিক থাকার কথা।

 

এর বাইরে এ বছর দেশে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে, যেখানে উৎপাদন হবে প্রায় ৫০ হাজার টন। এছাড়া পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর ভারতের নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে দেশটি থেকে ৫২ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির এলসি খোলা হয়। এসব পেঁয়াজও বাজারে আসছে। সরবরাহের সব খাত যোগ করলে এ সময় দেশে পেঁয়াজের সংকট থাকার কথা নয়।

 

সারা বছরের উৎপাদন ও জোগানের হিসাব করলেও পেঁয়াজ এখন উদ্বৃত্ত থাকার কথা। সরকারি হিসাবেই দেশে চাহিদার তুলনায় বেশি পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়ে থাকে। প্রতিবছর মুড়িকাটা, গ্রীষ্মকালীন এবং মূল মৌসুম মিলিয়ে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ৩৪ লাখ টনের বেশি। যার মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ সংগ্রহ থেকে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট হয়ে যাওয়া পেঁয়াজের ঘাটতি পূরণে বাকিটা আমদানি করতে হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের (২০২৩ সালের) শেষ ১১ মাসে পেঁয়াজের আমদানি ৮ লাখ ৬৪ হাজার টন ছাড়িয়ে গেছে। এই হিসাব ধরলে এ বছর ৪ থেকে ৫ লাখ টন পেঁয়াজ উদ্বৃত্ত থাকার কথা।

 

দেশে দৈনিক পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৮০ লাখ কেজি। যদি ধরা হয় প্রতি কেজিতে বর্তমানে ১২০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা। তাহলে বর্তমানে প্রতিদিন ভোক্তার পকেট থেকে শত কোটি টাকা বাড়তি মুনাফা করছেন পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা।

 

এমন পরিস্থিতিতে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কার্যত ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার অজুহাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছেন। এ যেন ভোক্তার অর্থ লুটের মচ্ছব। এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করে ভোক্তার পকেট থেকে দৈনিক শত কোটি টাকারও বেশি লুট হয়ে যাচ্ছে।

 

সাধারণ হিসাবে ধরা হয়, দেশে দৈনিক পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৮০ লাখ কেজি। যদি ধরা হয় প্রতি কেজিতে বর্তমানে ১২০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা। তাহলে বর্তমানে প্রতিদিন ভোক্তার পকেট থেকে শত কোটি টাকা বাড়তি মুনাফা করছেন পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা।

 

এসব বিষয়ে কথা হয় ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেনের সঙ্গে। নাজের হোসেন বলেন, ‘পেঁয়াজে যেটা হচ্ছে, সেটাকে ব্যবসা বলা যাবে না। ভোক্তাকে জিম্মি করে ডাকাতি চলছে। এটা সম্পূর্ণ অনৈতিক।’

 

তিনি বলেন, ‘কোথাও পেঁয়াজের সামান্য সংকট নেই। কোনো দোকানে পেঁয়াজ পাওয়া যায়নি, এমন ঘটনা কি হয়েছে? বরং বাজারে গিয়ে দেখবেন পেঁয়াজে ভরপুর। তারপরেও সংকটের কথা বলা হচ্ছে! ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানো হচ্ছে।’

 

এস এম নাজের হোসেন আরও বলেন, ‘বাজারে সুশাসনের ঘাটতির কারণেই এটা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা যেমন খুশি দাম নির্ধারণ করছেন, সরকারের কোনো বিধি-বিধানের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। পেঁয়াজের দাম কিন্তু সরকার ৬৫ টাকা বেঁধে দিয়েছে, কিন্তু সেটা শুধু কাগজে-কলমে রয়েছে। মাঝেমধ্যে ভোক্তা অধিদপ্তর কিছু জরিমানা করছে। যদিও তাতে ব্যবসায়ীদের কিছু যায় আসে না।’

 

তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটা বার্ষিক পরিকল্পনা থাকতে হবে। কখন আমদানি করবে আর কখন দেশীয় উৎপাদন দিয়ে চাহিদা পূরণ হবে, এরকম কোনো উদ্যোগ দেখিনি। তারা মজুত বা জোগানের কোনো পরিষ্কার তথ্যও দিতে পারে না। যেন সবকিছু অকার্যকর হয়ে রয়েছে।’

 

কোথাও পেঁয়াজের সংকট নেই। কোনো দোকানে পেঁয়াজ পাওয়া যায়নি, এমন ঘটনা কি হয়েছে? বরং বাজারে গিয়ে দেখবেন পেঁয়াজে ভরপুর। তারপরেও সংকটের কথা বলা হচ্ছে! ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানো হচ্ছে।

 

চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ৩৪ লাখ ৬০ হাজার টন। মজুতকালে অবচয় বাদ দিয়েও তা দাঁড়ায় ২৪ লাখ ২২ হাজার টন। একই সময়ে আমদানি অনুমতি দেওয়া হয় ২৪ লাখ ৮৩ হাজার টন। এরই মধ্যে ৭ লাখ ৪৩ হাজার টন আমদানি পেঁয়াজ দেশে এসেছে। এ হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশি ও আমদানি করা মিলিয়ে দেশে পেঁয়াজের প্রাপ্যতা ছিল ৩১ লাখ ৬৫ হাজার টন। যা চাহিদার তুলনায় ৩ লাখ ৬৫ হাজার টন বেশি।

 

প্রতিবছর পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ছে- এমন তথ্য দিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, গত ১১ বছরের ব্যবধানে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে ২১ লাখ টন। ২০১২-১৩ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ১৩ লাখ ৫৮ হাজার টন। যা এখন ৩৪ লাখ ৬০ হাজার টন। গত (২০২১-২২) অর্থবছরে পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ৩৪ লাখ টন। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ২৬ লাখ টন। অর্থাৎ দেশে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে পেঁয়াজের উৎপাদন।

 

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘উৎপাদন বাড়ার পরেও বাজার ব্যবস্থাপনায় সমস্যার কারণে সেই সুফল পাচ্ছে না ভোক্তারা।’

 

কৃষিখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি মাঝেমধ্যেই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। এতে বাংলাদেশে পেঁয়াজ চাষে আরও বেশি জোর দেয় সরকার। পাশাপাশি কয়েক বছর ধরেই ভালো দাম পাওয়ায় দেশের কৃষকরা পেঁয়াজ চাষে ঝুঁকেছেন। এতে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন যেমন বাড়ছে, ভোক্তার চাহিদাও মিটছে। এর ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি কমতে শুরু করেছে। তবে ব্যবসায়ীদের মনোভাবের পরিবর্তন হয়নি। পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও নানান ছুঁতোয় হুটহাট দাম বাড়ান এই নিত্যপণ্যের।