কেশভ মহারাজ আউট হতেই ইতিহাস লেখা হলো বাংলাদেশের নামে। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রোটিয়াদের বিপক্ষে অধরা জয়ের আক্ষেপ ঘুচলো বাংলাদেশ দলের। এর আগে সেখানে খেলা দ্বিপাক্ষিক সিরিজে কোনো ম্যাচই জেতেনি টাইগাররা। তিন ফরম্যাটে ১৯ ম্যাচ খেলে পরাজয় সবকটিতে। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে খেলা ১৪ ওয়ানডের কোনোটিতেই জয়ের স্বাদ পায়নি বাংলাদেশ দল। সেই আক্ষেপ ঘুচলো এবার। তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৩৮ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ।
নিজেদের ঘরের মাঠে খেলা সবশেষ সিরিজে ভারতকে নাস্তানাবুদ করে প্রোটিয়ারা। ৩ ম্যাচ সিরিজ জেতে ৩-০ ব্যবধানে। বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজেও ফেভারিট দলটির নাম দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে মাঠের ক্রিকেট যে আর পরিসংখ্যানের অঙ্কে মেলে না। সিরিজের প্রথম ম্যাচে আগে ব্যাট করে স্কোর বোর্ডে ৩১৩ রানের বিশাল সংগ্রহ জমা করে বাংলাদেশ দল। ৩১৪ রানের টার্গেট টপকাতে নেমে ২৭৬ রানে থামে দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস। এতে ৩৮ রানের জয়ের সঙ্গে আইসিসি সুপার লিগের গুরুত্বপূর্ণ ১০ পয়েন্ট পেল টাইগাররা।
৩১৪ রানের লক্ষ্য টপকাতে নেমে শুরুটা মোটেও ভালো হয়নি দক্ষিণ আফ্রিকার। টাইগার পেসারদের বোলিং তোপে পাওয়ার প্লেতে খেই হারিসে বসে স্বাগতিকরা। যদিও স্পিনার সাকিব আল হাসানের হাতে প্রথম বল তুলে দেন সফরকারী অধিনায়ক তামিম ইকবাল। তবে সফলতা এসেছে পেসারদের হাত ধরেই। ইনিংসে চতুর্থ ওভারেই আঘাত হানেন শরিফুল ইসলাম। ফেরান ওপেনার মালানকে। উইকেটের পিছনে মুশফিকের হাতে ক্যাচ দিয়ে ১০ বলে ৪ রান করেন তিনি।
প্রোটিয়ারা সেই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই স্বাগতিক শিবিরে জোড়া আঘাত হানেন তাসকিন আহমেদ। ইনিংসের নমব ওভারের প্রথম ও চতুর্থ বলে ফিরিয়ে দেন কাইল ভেরেইনা ও এইডেন মারর্কামকে। চমৎকার এক ডেলিভারির লাইনে যেতে পারেননি ভেরেইনা। আম্পায়ার এলবিডব্লিউর জোরাল আবেদনে সাড়া দিলে রিভিউ না নিয়েই ফেরেন তিনি। করেন ২৫ বলে ২১ রান। দুই বল পর ড্রাইভ করার চেষ্টায় পয়েন্টে মেহেদী হাসান মিরাজের হাতে ধরা পড়েন মারর্কাম। ৩ বল খেলে তিনি খুলতে পারেননি রানের খাতা।
৩৬ রান তুলতেই ৩ উইকেট হারিয়ে বসে দক্ষিণ আফ্রিকা। সেখান থেকে দলকে টেনে তোলার চেষ্টা করেন অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা আর মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান ভ্যান ডার ডুসেন। দেখেশুনে খেলে চতুর্থ উইকেটে দুই জন যোগ করেন ৮৫ রান। এই পার্টনারশিপ যখন বিপদের ইঙ্গিত দিতে থাকে, তখন বাভুমাকে ফিরিয়ে ব্রেক থ্রু এনে দেন শরিফুল। বাড়তি বাউন্স করা বল ঠিক মতো খেলতে পারেননি বাভুমা। বল তার ব্যাটের কানা ছুঁয়ে জমা পড়ে মুশফিকের গ্লাভেস। ৫৫ বলে ২টি চারের সাহায্যে ৩১ রান করেন বাভুমা।
তার আগেই অবশ্য অর্ধশতকের স্বাদ পান ডুসেন। বাভুমা ফিরে যাওয়ার পর জুটি বাঁধেন ডেভিড মিলারের সঙ্গে। এই জুটি যেমন বিপদের বার্তা দিতে থাকে বাংলাদেশকে, তেমনি শতকের দিকে ছুটতে থাকেন ডুসেন। এই পার্টনারশিপ ভাঙতে একের পর এক বোলার বদলাতে থাকেন তামিম। পরে সফলতা আসে তাসকিনের হাত ধরে। তাতে অবশ্য দারুণ অবদান ইয়াসিরের। অফ স্টাম্পের বাইরের বল হাঁটু গেড়ে লেগে ঘুরান ডুসেন। অনেকটা ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে ক্যাচ নেন ইয়াসির। ভাঙে ৬৪ বল ৭০ রানের জুটি। ডুসেন ফেরেন ৮৬ করে। ৯৮ বলে ৯টি চার ও ১টি ছক্কা হাঁকান এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান
এরপর মিলার আগ্রাসী ব্যাটে তুলে নেন ঝড়ো ফিফটি। মাত্র ৩৮ বলে অর্শশতক পূর্ণ করেন তিনি। তবুও চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রান তুলতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই চাপ কমাতে গিয়ে উল্টো আরো বিপদে পড়ে তারা। এবার স্বাগরতিক ব্যাটসম্যানদের ত্রাস বনে যান মিরাজ। শুরুতে রান খরচ করলেও ইনিংসের ৪২তম ওভারে এসে আউট করেম আন্দিলে ফেলুকওয়ায়োকে। লং অফে সহজ ক্যাচ নেন লিটন দাস। ১৩ বলে স্বাগতিক অলরাউন্ডার করেন কেবল ২ রান।
পরের ওভারে জোড়া আঘাত মিরাজের। এবার শিকার মার্কো ইয়ানসেনের আর কাগিসো রাবাদা। অফ স্পিনারকে ছক্কার চেষ্টায় সীমানায় তামিমের হাতে ধরা পড়েন ইয়ানসেন। করেন ২ রান। ছক্কার চেষ্টায় আকাশে তুলে দেন রাবাদাল। কিপার মুশফিক ছুটে এসে বোলিং প্রান্তে নিতে চেয়েছিলেন ক্যাচ। তবে মিরাজই মুঠোয় জমান। রাবাদা ফেরেন ১ রানে। এরপর মিলারও প্রতিরোধ গড়তে পারেননি। মিরাজের চতুর্থ শিকারে পরিণত হন স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে পড়ে। ৫৭ বলে তিন ছক্কা ও আট চারে ৭৯ রান করেন মিলার।
শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে কেশভ মহারাজ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের বলে আউট হলে ২৭৬ রানেই গুটিয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস। এতে ৩৮ রান এবং ৭ বল হাতে রেখেই ইতিহাস গড়া জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ দল। সফরকারীদের পক্ষে মিরাজ ৪, তাসকিন ৩ এবং শরিফুল নেন ২ উইকেট।
এর আগে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ দল। ঝুঁকি না নিয়ে দেখেশুনে খেলেন দুই ওপেনার তামিম ইকবাল আর লিটন দাস। পাওয়ার-প্লের ১০ ওভারে তোলেন মোটে ৩৩ রান। প্রথম ১৫ ওভারেও দলীয় স্কোর পঞ্চাশ ছুতে পারেনি। এরপরেই খোলস ছাড়তে শুরু করেন তারা। দুই জনেই ছোঁটেন অর্ধশতকের দিকে। কিন্তু ইনিংসের ২২তম ওভারে ফেলুকওয়ায়োর বলে এলবিডব্লিউ হন তামিম। ৬৭ বলে ৩টি চার ও ১টি ছক্কায় করেন ৪১ রান। ভাঙে ৯৫ রানের উদ্বোধনি পার্টনারশিপ।
তামিমের আউটের পর ব্যক্তিগত ফিফটি করে একই পথ ধরেন লিটন। আগের বলে দুই রান নিয়ে অর্ধশতক পূরণ করেন। পরের বল সরে গিয়ে কাট করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বল নিচু হয়ে যাওয়ায় ব্যাটে খেলতে পারেননি। হয়ে যান বোল্ড। ৬৭ বলে এক ছক্কা ও পাঁচ চারে ৫০ রান করেন লিটন। এরপর দলকে টেনে তোলার দায়িত্ব পড়ে মুশফিকুর রহিম আর ‘আলোচিত’ সাকিব আল হাসানের কাঁধে। কিন্তু এ যাত্রায় ব্যর্থ মুশফিক। নিজের প্রিয় শট স্লগ সুইপ খেলতে গিয়ে গড়বড় করে ফেলেন। এক চারে ১২ বলে মুশফিক করেন ৯ রান।
দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে বাংলাদেশ। সেখান থেকে হাল ধরেন সাকিব আল হাসান আর ইয়াসির আলি রাব্বি। একশর উপর স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করে দলের বাড়ান দুই জন। ইনিংসের ৩৮তম ওভারের শেষ বলটি লং অফ দিয়ে উড়িয়ে বাউন্ডারি পার করে ফিফটি তুলে নেন সাকিব। ৫০ বলে পেয়ে যান ক্যারিয়ারের ৫০তম হাফ সেঞ্চুরির দেখা। পরে আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে হাঁটছিলেন শতকের দিকে, কিন্তু ইনিংসে ৪২তম ওভারে ব্যক্তিগত ৭৭ রানের মাথায় লুঙ্গি এনগিডির বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ফেরেন। ৬৪ বলের ইনিংসে ৩টি ছক্কা ও ৭টি চার মারেন সাকিব।
সাকিবের সঙ্গে ৮২ বল স্থায়ী ১১৫ রানের জুটি ভাঙার আগেই নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটির স্বাদ পান রাব্বি। তবে লিটনের মতো তিনিও ফেরেন সমান ৫০ রানে। দুই ছক্কা ও চারটি চারে ৪৩ বলে পঞ্চাশ ছুঁয়েছেন তিনি। শেষদিকে ব্যাট হাতে ঝড় তুলেছিলেন আফিফ হোসেন, কিন্তু স্থায়ী হতে পারলেন না। ১৩ বলে খেলা ১৭ রানের ইনিংসে সমান ১টি চার-ছয় মারেন এই তরুণ। আফিফ আউট হলে দলীয় স্কোর বাড়াতে গিয়ে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও ফেরেন ১৭ বলে ২৫ রানে।
পরে মেহেদী হাসান মিরাজের আগ্রসী ব্যাটে ১৩ বলে অপরাজিত ১৯ এবং তাসকিন আহমেদের ৫ বলে ৭ রানের সুবাদে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে ৭ উইকেট হারিয়ে স্কোর বোর্ডে ৩১৩ রানের সংগ্রহ পায় বাংলাদেশ দল। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে কেশভ মহারাজ ও জানসেন ২টি করে উইকেট নেন।