ঢাকা, রবিবার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

নগরীর নালা মানেই মূর্তিমান আতংক !

চট্টগ্রাম ব্যুরো : | প্রকাশের সময় : বুধবার ১২ জানুয়ারী ২০২২ ১০:২৪:০০ অপরাহ্ন | চট্টগ্রাম প্রতিদিন

বিগত ছয় মাসেই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের স্ল্যাববিহীন উন্মুক্ত নালায় পড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ৫ জন তাদের মধ্যে ১ জনের খোঁজ পাওয়া যায়নি।

নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তারা দুর্ঘটনার জন্য চট্টগ্রাম নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে দায়ী করেছেন।

এদের মধ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়েছে, সেখানেও স্থানীয় সরকার, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে বিবাদী করা হয়েছে।

 

বৃষ্টি শুরু হলেই চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করতো জলাবদ্ধতা নিয়ে।নগরীর উন্মুক্ত খাল ও ড্রেনগুলো রীতিমতো মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে।

চলতি বছরের ৩০ জুন নগরীর ষোলশহর চশমা হিল এলাকায় যাত্রীবাহী সিএনজি অটোরিকশা উন্মুক্ত খালে পড়ে ডুবে যায়।এতে অটোরিকশা চালক সুলতান (৩৫) ও যাত্রী খাদিজা বেগম (৬৫) নামে দু’জনের মৃত্যু হয়।

এক মাস পেরোতেই চলতি বছরের আগস্ট মাসে নগরীর মুরাদপুর এলাকায় পা পিছলে নালায় তলিয়ে যান ব্যবসায়ী সালেহ আহমদ (৫৫) ,যার আর কোন সন্ধান মিলেনি।

পরের মাস ২৭ সেপ্টেম্বর শহরের আগ্রাবাদ মাজার গেইট এলাকায় চশমা কিনে ফুটপাত ধরে হেঁটে বাসায় ফেরার পথে উন্মুক্ত নালায় পড়ে নিখোঁজ হন আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া (১৯)।দীর্ঘ ৬ ঘণ্টা ফায়ার সার্ভিস অভিযান চালিয়ে ড্রেনের গভীর থেকে সাদিয়ার মৃতদেহ উদ্ধার করে।

চলতি মাসের ৪ ডিসেম্বর পানিতে ভেসে যায় কামাল নামের ১০ বছরের পথ শিশু, নিখোঁজের ৩ দিন পর লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। 

সর্বশেষ এক কলেজ ছাত্র নালায় পড়ে পা ভেঙেছে।এর আগে গত ১৯ জুন চান্দগাঁও আবাসিকে বৃষ্টির মধ্যে সিএনজি অটোরিকশা উল্টে নালায় পড়ে যায় এতে ৩ জনকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান।

এসকল মৃত্যুর ঘটনার পরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একে অপরের উপর দায় চাপালেও নালায় পড়ে মৃত্যু ও দুর্ঘটনা থামেনি।

 

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, একাধিক সংস্থার নগরের ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব থাকায় এসকল এক্সিডেন্টগুলোতে দায়িত্বরত সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দায় এড়িয়ে চলছেন।নগরের সকল সংস্থাসমূহ দায় চাপানোর সংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে এসে নিজেদের উপর অর্পিত সঠিক দায়িত্বপালন এবং নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করলে এসকল দুর্ঘটনা এড়ানো অনেকটা সম্ভব বলে মনে করছেন।

 

চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস বিভাগের উপ-পরিচালক ফরিদ আহাম্মদ জানান, গত ৬ মাসে ড্রেনে পড়ে ৫ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে সালেহ আহামদ নামে একজনের লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

মূলত উন্মুক্ত ড্রেন এবং ব্যক্তি অসচেতনতার কারণে এমন দুর্ঘটনা ঘটছে বলে তিনি মনে করছেন।

 

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সম্পাদক এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী দৈনিক বায়ান্নকে বলেন, চট্টগ্রাম সিটির নাগরিকদের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ উক্ত ঘটনার দায় এড়াতে পারেনা বলেই কৌশল হিসেবে একে অপরকে দোষারোপ করে পার পাওয়ার চেষ্টা চালায় বারবার।কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় মৃত্যুর ঘটনাগুলো গণমাধ্যম প্রকাশ করলেও নালায় ও নগরীর বিভিন্ন জায়গায় খানা খন্দে পড়ে আহত হওয়া অসংখ্য ঘটনা অপ্রকাশিত থেকে যায়।নগর উন্নয়নের দায়িত্ব যেমন সিটি কর্পোরেশন ও সিডিএ’র উপর তেমনি রক্ষনাবেক্ষন,সংস্কার সব দায়-দায়িত্ব তাদের উপর। দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর অবহেলার কারণে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় নিহত হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের খোঁজ র্পযন্ত নিচ্ছে না,আমরা মনে করছি সেগুলো দুর্ঘটনা নয় যেন নরহত্যার দায়িত্ব পালন করছেন।জবাবদিহিতার অভাব, দায়িত্বে অবহেলা আর নগর পরিচালনায় প্রচণ্ড দুর্বলতা রয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীল বিভিন্ন কমিশনের যথাযথ জবাবদিহিতার প্রয়োগ না হওয়ায় নাগরিকরাই দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কর্মকাণ্ড বা অবহেলায় ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলে উন্নত দেশগুলোতে আইনি প্রতিকার ও ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ থাকে।

সংস্থার নির্বাহীরা নির্বাচিত বা মনোনীত যেভাবেই দায়িত্ব পাননা কেন,তারা পরস্পর সমন্বয়ের মাধ্যমে নাগরিক সেবা নিশ্চিতে সততার সহিত কাজ করলে এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবেনা।

এরকম দুর্ঘটনা ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করাও জরুরি। সেই দায়িত্বও স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে বলে সুজন সম্পাদক এ্যাডভোকেট আকতার কবির মনে করেন।

 

WhatsApp Image 2021-12-25 at 4.23.13 PM
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোঃ রেজাউল করিম চৌধুরী , দুর্ঘটনা ঘটেছে তার জন্য আমরা অত্যন্ত দুঃখিত,দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করা সকলের পরিবারের প্রতি আমরা গভীর সমবেদনা জানায়।জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পের আওতায় ড্রেনের কাজ চলায়, সামান্য বৃষ্টি হলেই সড়ক আর নালা একাকার হয়ে যায়।কাজের সময় কোন ফেন্সিং না দেওয়াতে পথচারীরা বুঝতে না পারায় দুর্ঘটনাগুলো হচ্ছে।

৪ ডিসেম্বর যে শিশুটি একটি খালে তলিয়ে গিয়ে মারা গেছেন, সেই শিশুটি বোতল সংগ্রহ করতে গিয়ে খালে নেমেছিল বলেই জানান সিটি মেয়র।

কিন্তু আর যাতে সেরকম কোন ঘটনা না ঘটে, সেজন্য গতমাস থেকেই আমরা কাজ শুরু করেছি। ড্রেনগুলোর ওপর স্ল্যাব বসানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি সতর্কতা ও সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। সাধারণ মানুষ অসচেতনটার কারণে ড্রেনে আবর্জনা ফেলে ড্রেনগুলোকে ময়লার ভাগারে পরিণত করছে।  

তিনি আরও জানান, শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে খালের কাজ চলছে। সেগুলো তাদের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হলে তারা বিপদজ্জনক অংশগুলো শনাক্ত করে নিরাপত্তার উদ্যোগ নেবেন।

সিটি মেয়র বলছেন, ''বড় বড় খালের সব জায়গায় তো করা সম্ভব না, কিন্তু যেখানে নিরাপত্তা দরকার, সেখানে দেয়াল তুলে, না হলে লোহার গ্রিল দিয়ে, যেভাবে হোক একটা প্রোটেকশন ব্যবস্থা আমরা করব।