অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে ইউরোপের তিন দেশ স্পেন, নরওয়ে ও আয়ারল্যান্ড। ইউরোপের এই তিন দেশ মনে করে, তাদের এমন সিদ্ধান্তের শক্তিশালী প্রতীকী প্রভাব রয়েছে। যা অন্যান্যদের একই সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহ জোগাবে। যদিও তিন দেশের এমন সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে ইসরায়েল। তারা বলেছে, যুদ্ধের মাঝে এমন সিদ্ধান্ত হামাসের জন্য পুরস্কার।
মঙ্গলবার নরওয়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ঘোষণা করেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসপেন বার্থ এইড। এই পদক্ষেপকে ‘‘নরওয়ে-ফিলিস্তিন সম্পর্কের জন্য বিশেষ দিন’’ বলে অভিহিত করেন তিনি।
এসপেন বলেন, ‘‘৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সবচেয়ে উৎসাহী রক্ষকদের অন্যতম নরওয়ে।’’
নরওয়ের ঘোষণার কিছুক্ষণ পরই স্পেন ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়। স্পেনের সরকারের মুখপাত্র পিলার অ্যালেগ্রিয়া বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, মন্ত্রিসভা আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। একই সঙ্গে মন্ত্রিসভার সদস্যরা এটাকে ‘‘এক ঐতিহাসিক দিন’’ বলে অভিহিত করেছেন।
এর আগে, স্প্যানিশ প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো স্যানচেজ বলেন, এই ধরনের স্বীকৃতি শান্তির জন্য অপরিহার্য। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, তার দেশের এই পদক্ষেপ ‘‘কারও বিরুদ্ধে নয়, বরং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে।’’ ইসরায়েলের পাশে শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করার একমাত্র উপায় এই ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র।
তিনি বলেন, স্পেনের এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের বিরোধী হামাসকেও সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। যাদের ৭ অক্টোবরের কর্মকাণ্ডের কারণে গাজা যুদ্ধের সূচনা হয়েছে।
একইভাবে মঙ্গলবার আয়ারল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইকেল মার্টিনও ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, আয়ারল্যান্ড আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনের সাথে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে আয়ারল্যান্ড।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া বার্তায় তিনি বলেন, আয়ারল্যান্ডের সরকারের আজকের সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সাথে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনেরও অনুমতি দেয়। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক অনুরোধের ভিত্তিতে আয়ারল্যান্ডে ফিলিস্তিনি মিশনের মর্যাদা দূতাবাসে উন্নীত করা হবে বলেও জানান তিনি। পাশাপাশি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র থেকে আয়ারল্যান্ডে একজন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হবে।
মার্টিন বলেন, ‘‘ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি একটি প্রক্রিয়ার শেষ নয়; বরং শুরু। এটা আমাদের দীর্ঘস্থায়ী পারস্পরিক উন্নয়ন সহযোগিতা কর্মসূচির গুরুত্ব তুলে ধরে।’’
মন্ত্রিসভার সদস্যদের সাথে বৈঠকের আগে মঙ্গলবার আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সাইমন হ্যারিস বলেছিলেন, ‘‘এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। কারণ একটি দেশ হিসেবে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের আশা বাঁচিয়ে রাখতে সহায়তা করার জন্য এমন একটি বাস্তব পদক্ষেপ যে নেওয়া যায়, এই সিদ্ধান্ত সেই বার্তা দেবে।’’
• ইউরোপীয় ইউনিয়নে মতবিরোধ
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে ২৭ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) তীব্র মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে।
দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিকে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মাঝে আলোচনার মাধ্যমে শান্তি স্থাপনের শেষ উপায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার বেশিরভাগ পশ্চিম ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলো বলেছে, তারা একদিন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে ইচ্ছুক। তবে জেরুজালেমের মর্যাদা ও উভয় রাষ্ট্রের সীমান্ত চূড়ান্ত করার মতো কঠিন বিষয়গুলোর সমাধান না করা পর্যন্ত এই স্বীকৃতি দিতে চায় না তারা।
গাজায় প্রতিনিয়িত ফিলিস্তিনিদের রক্ত ঝড়ছে। আর এই রক্তপাতই ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্রের দাবিকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলছে। মঙ্গলবারের এই পদক্ষেপের মাধ্যমে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য দেশের মধ্যে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া দেশের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৪৫টিতে।
এর আগে, ২০১৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রথম সদস্য দেশ হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয় সুইডেন। এরপরই ইউরোপের অন্য ছয় দেশ— বুলগেরিয়া, সাইপ্রাস, চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড এবং রোমানিয়াও একই পথে হাঁটে।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ঢুকে হামলা চালায় গাজার ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী হামাসের শত শত যোদ্ধা। ওই দিন ইসরায়েলে এক হাজার ১৭০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করে হামাসের সদস্যরা। একই সঙ্গে আরও ২৫২ জনকে ধরে নিয়ে গাজায় জিম্মি করে রাখে হামাস; যাদের মধ্যে এখনও ১২১ জন গাজায় জিম্মি অবস্থায় রয়েছেন। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, হামাসের হাতে বন্দি জিম্মিদের মধ্যে অন্তত ৩৭ জন মারা গেছেন।
পরে ওই দিনই গাজা উপত্যকায় ব্যাপক যুদ্ধ শুরু করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, সাত মাসের বেশি সময় ধরে চলা ইসরায়েলের যুদ্ধে গাজা উপত্যকায় ৩৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণহানি ঘটেছে।
স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ে বলেছে, তারা ১৯৬৭ সালের আগের সীমানা বহাল রেখে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিচ্ছে। পাশাপাশি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন— উভয়ের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে মানবে তারা।