ঢাকা, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের রাজনীতি

বিতর্ক লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে

Author Dainik Bayanno | প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার ২০ জানুয়ারী ২০২২ ০২:৩৯:০০ পূর্বাহ্ন | রাজনীতি

 

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিবাচক-নেতিবাচক প্রচারণার লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে এবার বিতর্ক শুরু হয়েছে। প্রথম মুখ খুললেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেন, বিএনপি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণায় ৩.৭৫ মিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় করেছে। জবাবে বিএনপি নেতারা বলছেন, লবিস্ট নিয়োগের বিষয়টি বানোয়াট। সরকার নিজেদের রক্ষা করতে এ ধরনের কান্ড ঘটাচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যয় করছে অর্থ। পাল্টাপাল্টি এই বাস্তবতা নিয়ে কূটনীতিক মহল বলছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ নতুন নয়। অতীতেও রাজনৈতিক দলগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের পক্ষে জনমত তৈরিতে এমন কাজ করেছে।

 

এদিকে গতকাল লবিস্ট নিয়োগের বিষয়ে কথা বলেছেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদও। তিনি বলেন, বিএনপি অর্থ ব্যয় করে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। ফলে এ দেশে তাদের রাজনীতি করার অধিকার থাকে কি না, এটাই এখন প্রশ্ন। আর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপি যেসব লবিস্টের সঙ্গে চুক্তি করেছে, সেসব চুক্তির কপি জাতীয় নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে। নিজ নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তারা এসব কথা বলেন।

 

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই বৈধভাবে লবিস্ট নিয়োগ দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষায় এসব দেশে লবিস্ট নিয়োগ দেয় অনেক দেশ। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতেও লবিস্ট নিয়োগের প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশে অনেক ব্যবসায়ীও নিজেদের বাণিজ্যের প্রয়োজনে লবিস্ট নিয়োগ দেন। তবে রাজনৈতিকভাবে সরকার বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লবিস্ট নিয়োগের প্রচলন কোনো দেশেই নেই বলে জানা গেছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য সাধারণত লবিস্ট নিয়োগ করে থাকে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন কোম্পানিও তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য লবিস্ট নিয়োগ করে

লবিস্ট নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির  বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য সাধারণত লবিস্ট নিয়োগ করে থাকে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন কোম্পানিও তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য লবিস্ট নিয়োগ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগের  বিষয়টি একটি বৈধ প্রক্রিয়া। যারা লবিস্ট হিসেবে কাজ করেন, তারা ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস থেকে লাইসেন্স নিয়েই কাজ করেন। তিনি বলেন, বিশ্বের কোনো দেশে রাজনৈতিক দল লবিস্ট নিয়োগ করে কি না, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তো পত্র-পত্রিকায় লবিস্ট নিয়োগের খবর পাচ্ছি। বিষয়টি রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নষ্ট করা ছাড়া কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না।

 

যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি অভিযোগ সম্পর্কে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও বিশিষ্ট কূটনীতিক শমসের মবিন চৌধুরী বলেছেন, ‘দুই দলের এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করাটা আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা দুর্বলতা। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে সহসাই এ ধরনের পাল্টা অভিযোগ করে থাকে। তবে লবিস্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখতে হবে- সেটি দেশের বিরুদ্ধে কি না, কিংবা জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী কি না? যদি জনস্বার্থের পরিপন্থী হয় তাহলে সরকার তা খতিয়ে দেখতে পারে যে সেটি কীভাবে হয়েছে, কারা করেছে। তবে বিএনপি কী করেছে অথবা এ সম্পর্কে কী বলেছে তা আমি জানি না।’ সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ২০০৪ সালে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে আমেরিকায় শুল্কমুক্ত তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য সে দেশের পার্লামেন্টে আইন পাস করাতে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা সে ক্ষেত্রে সফল হতে পারেনি। কিন্তু সেই লবিস্ট নিয়োগের প্রচেষ্টাটা ছিল ইতিবাচক। সেটি ছিল দেশের কল্যাণে, জনমানুষের স্বার্থে। এখন কেউ যদি দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো লবিস্ট কোথাও নিয়োগ করে থাকে, তবে সে ক্ষেত্রে সরকার কোথা থেকে কীভাবে কী হয়েছে তা খতিয়ে দেখতেই পারে।

 

লবিস্ট নিয়োগের আইনগত বৈধতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক  বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট একটি স্বাভাবিক বিষয়। সহজ কথায় লবিস্ট অর্থ হচ্ছে তদবিরকারক। আমাদের দেশে যেমন এলাকার উন্নয়নে অনেক সময় সংসদ সদস্যরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কাছে গিয়ে তদবির করেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশও নিজেদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করে থাকে। অনেক বড় বড় কেম্পানিও লবিস্ট নিয়োগ করে। তিনি বলেন, ‘আমরা না বুঝে লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক করছি। তদবির করার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগের বিষয়ে আইনও রয়েছে। যে-কেউ চাইলেই লবিস্ট হতে পারবে না। তাকে অবশ্যই নিবন্ধিত হতে হবে।’ তিনি বলেন, কেউ বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ দিতে চাইলে তাকে বাংলাদেশ থেকেই টাকা নিতে হবে বিষয়টি এমন নয়। ওই দেশে অবস্থানকারী তার পরিচিতজনরাও এ টাকা পরিশোধ করতে পারেন।

 

অর্থ ব্যয় করে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে বিএনপি-তথ্যমন্ত্রী : তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেছেন, বিএনপি অবৈধ অর্থ ব্যয় করে দেশের বিরুদ্ধে বিদেশে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছে। বিএনপির ষড়যন্ত্রের দালিলিক প্রমাণ সরকারের হাতে আছে। ফলে এ দেশে তাদের রাজনীতি করার অধিকার থাকে কি না, তিনি সে প্রশ্ন তুলেছেন। গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এসব কথা বলেন।

 

তথ্যমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট, বিশেষ করে বিএনপি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এ কথা আমরা বহু দিন ধরে বলে আসছি। এর পরও হয়তো অনেকের মনে নানা প্রশ্ন ছিল। প্রকৃতপক্ষে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি রুখে দেওয়ার জন্য, দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য বিএনপি রীতিমতো অর্থ ব্যয় করে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন জায়গায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করছে।

 

চুক্তির কপি নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে- পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী : পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপি যেসব লবিস্টের সঙ্গে চুক্তি করেছে, সেসব চুক্তির কপি জাতীয় নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে। গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি এ কথা বলেন। শাহরিয়ার আলম বলেন, বিএনপি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে লবিস্ট নিয়োগে যে চুক্তি করেছে, সেসব চুক্তির কপি নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে। কেননা প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে আয়-ব্যয়ের হিসাব নির্বাচন কমিশনে দাখিল করতে হয়। বিএনপি নির্বাচন কমিশনে এই অর্থের হিসাব দাখিল করেছে কি না কমিশনকে খতিয়ে দেখতে অনুরোধ করা হয়েছে।

 

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছেও চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিএনপি চুক্তির জন্য বিদেশে যে অর্থ পাঠিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অনুমোদন রয়েছে কি না যাচাই করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।

 

মঙ্গলবার বিএনপির লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে শাহরিয়ার আলম বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াত বিদেশি লবিস্ট নিয়োগে আটটি চুক্তি করেছে। এর মধ্যে তিনটি চুক্তি করেছে বিএনপি। এই তিন চুক্তিতে বিএনপি ৩.৭৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। বিএনপি অফিসের ঠিকানাও চুক্তির কপিতে উল্লেখ করা হয়েছে। জামায়াতের চুক্তির কপিতে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা দেওয়া নেই। তবে চুক্তির কপিতে তাদের নাম রয়েছে। প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে তারা চুক্তি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে এসব চুক্তির অনুমোদন রয়েছে। তবে এই চুক্তির অর্থ কীভাবে এলো, আমরা সে বিষয়ে খতিয়ে দেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাই। এর আগে ১৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ অধিবেশনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বিএনপি-জামায়াতের লবিস্ট নিয়োগে অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি তুলে ধরেন।

 

লবিস্ট নিয়োগের অভিযোগ ভিত্তিহীন- বিএনপি : বিদেশে বিএনপির লবিস্ট নিয়োগের বিষয়টি মিথ্যা দাবি করে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানোয়াট। গতকাল দুপুরে শেরেবাংলা নগরে জিয়াউর রহমানের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। ড. মোশাররফ বলেন, ‘যখন আমেরিকা থেকে একটি সংস্থা এবং উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা এসেছে, যখন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক সামিটে দাওয়াত পায় না, তখন কিন্তু এই কথাগুলো উঠছে। আমাদের প্রশ্ন, আগে কেন এ কথা উঠল না। আমরা কিছুদিন আগে থেকে পত্রিকায় দেখছি আওয়ামী লীগ এ দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, চুরি-ডাকাতি করে অর্থ লুণ্ঠন করছে। এগুলো যাতে ধামাচাপা দেওয়া যায় সে জন্য বিদেশে তারা লবিস্ট নিয়োগ করেছে ১৪ বছর ধরে। এটা যখন পত্রিকায় বেরিয়েছে তখন এ সরকার কতগুলো ভিত্তিহীন বানোয়াট ডকুমেন্ট দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য এ ধরনের কথা বলছে। এগুলো সম্পূর্ণ বানোয়াট। আমাদের বক্তব্য পূর্ণাঙ্গভাবে একটি প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে জানাব।’