ঢাকা, শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্যুৎ কর্তাদের ম্যানেজ করেই নগরের অলিগলিতে বাড়ছে ব্যাটারী চালিত রিক্সা গ্যারেজ

কাজী হুমায়ুন কবির : | প্রকাশের সময় : সোমবার ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ১০:৪০:০০ অপরাহ্ন | চট্টগ্রাম প্রতিদিন
  • চলছে টোকেন ব্যবসা
  • চলছে চাঁদাবাজী
  • সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব

শীত শেষে শুরু হতে যাচ্ছে গরম। নেই জনমনে স্বস্তি। গরমকাল শুরু হলেই লোডশেডিংএর ভয় শুরু হতে থাকে জনমানুষের মনে। বিদ্যুতের সেবা সঠিকভাবে পাবেতো নগরীর নাগরিকরা। যেভাবে চট্টগ্রাম মহানগরীর অলি গলিতে প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে দাপিয়ে চলছে প্রায় ১০হাজারের বেশী ব্যাটারি চালিত রিকশা। সেই সাথে বাড়ছে ব্যাটারী চালিত রিকসার ব্যাটারী চার্জ দেওয়ার অবৈধ গ্যারেজ। এলাকার অনাবাদি খালি জায়গা বা অব্যবহৃত খালি জায়গা ভাড়া নিয়ে টিনের ঘেরাও বা বাশের বেড়ার ঘেরাও দিয়ে যত্রতত্র গড়ে উঠছে এসব গ্যারেজ। এসব গ্যারেজে প্রকাশ্যে মিটার থাকলেও প্রতিনিয়ত চুরি হয় বিদ্যুত। অভিযোগ রয়েছে,  তারা বিভিন্ন উপায়ে বিদ্যুত অফিস থেকে মিটার সংগ্রহ করলেও রাতে বা সুযোগে মুল মিটার থেকে বিদ্যুত ব্যবহার না করে চোরাই পন্থায় বিদ্যুত ব্যবহার করে। এসব গ্যারেজের নাই ট্রেড লাইসেন্স। জানা যায়, সন্ধ্যা গড়িয়ে এলে লাইসেন্স বিহীন অবৈধ রিক্সার প্রায় গ্যারেজগুলোতে হরহামেশায় বসে জুয়া ও তাসের আসর। 

জানা যায়, এই ব্যাটারী চালিত রিক্সা ও গ্যারেজের সুবাধে কয়েকটি চাঁদাবাজ চক্র গড়ে উঠেছে। নগরের অলিগলির সড়কে এসব রিক্সার চলাকে কেন্দ্র করে প্রতিটি এলাকায় টোকেনের মাধ্যমে টাকা তোলেন প্রভাবশালী একজন। এলাকাভেদে ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা করে প্রতিটি ড্রাইভার থেকে টোকেনে টাকা তুলেন। তার রয়েছে অনেক প্রভাব। তিনি ম্যানেজ করেন প্রশাসনসহ অন্যান্যদের। তার মুল কাজ হলো যারা এদের বিরুদ্ধে কথা বলবে, তাদেরকে ম্যানেজ করা। অক্সিজেন বায়েজিদ, বাংলাবাজার, চন্দ্রনগর, ডেবারপাড়, টেক্সটাইল রুবি গেইট এলাকায় চালকদের সাথে কথা বললে বারবার সামুশু নামে এক ব্যাক্তির নাম উঠে আসে প্রতিবেদকের কাছে। যার অধিনে রয়েছে প্রায় ৫০০শর মতো  ব্যাটারি রিকসা। সামশু তার একান্ত কর্মি কাজলের মাধ্যমে প্রতিটি গাড়ি থেকে ১০০ থেকে ১২০ টাকা করে তোলেন । জানা যায়, প্রতিদিন উত্তোলিত প্রায় ৫০ হাজার মতো । সে টাকার এমাউন্ট থেকে প্রশাসন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পিডিবিতে সহযোগী কর্মরত লাইনম্যানদের এই প্রাপ্ত টাকার একটা নির্দিষ্ট অংশ দেন।

অক্সিজেন, আতুরার ডিপো, হাজিপাড়ার চালকদের সুত্রে পাওয়া যায় এনামের নাম। কয়েকজন চালক ও গ্যারেজ মালিক বলেন, এনামসাব এইসব এলাকার টোকেনের টাকা তোলেন। যার অধিনে রয়েছে প্রায় ২শ‘র মতো ব্যাটারী চালিত রিকসা। তিনিই আমাদের বাইরের চাপগুলো সমাধান করেন। টাইগারপাশ, আমবাগান, পাহাড়তলী সরাইপাড়া এলাকায় গেলে কয়েকজন ব্যাটারী রিকসা চালক সুত্রে জানা যায়, এসব এলাকার টাকা তোলেন মোহাম্মদ সুমন নামের একজন। তার অধীনে রয়েছে প্রায় ৫শ‘র মতো রিকসা। তিনি এসব ব্যাটারী গাড়ির টোকেনের টাকা তোলেন। টেকনিক্যাল, মোজাফ্ফর নগর, সাউদার্ন মেডিকেল এলাকার কয়েকজন ব্যাটারি চালক সুত্রে জানা যায়, এসব এলাকায় টাকা তোলেন সামশুর অনুগত জসিম ও নাছির। টাকা না দিলে অনেক সময় ড্রাইভারদের সাথে দুব্যবহারসহ গাড়ি বন্ধ করে দেন। একজন ব্যাটারী রিক্সা চালক বলেন, এসব ব্যাটারি চালিত রিক্সা চলাচলকে কেন্দ্র করে প্রতিটি এলাকায় গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। জানা যায়, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরাও এই সিন্ডিকেটগুলো থেকে সুবিধা নিচ্ছে। টোকেনের টাকা না দিলে তাদেরকে লেলিয়ে দেয় তারা, যার ফলে গাড়ি বন্ধসহ অত্যাচারের শিকার হতে হয়। আরেক চালকসুত্রে জানা যায়, মুল সড়কে আসলে পুলিশ গাড়ি টু করলে ট্রাফিকদেরও নিয়ন্ত্রন করতে হয়। 

অন্যদিকে কোন আইনের তোয়াক্কা করছেনা ব্যাটারী চালিত রিকসার গ্যারেজ মালিকরা। এসব ব্যাটারী চালিত রিক্সার গ্যারেজে অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহার করার অভিযোগ থাকলেও কোন ভুমিকা নিচ্ছেনা বিদ্যুত অফিস। তাদের কাছে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে, তারা বলে আমরা বিষয়টি দেখছি। আপনাদের কাছে কোন তথ্য থাকলে আমাদের দিয়েন। আমরা ব্যবস্থা নিবো। সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর বায়েজীদের চন্দ্রনগরে নাছির, মোক্তার ও আনোয়ারের গ্যারেজ, ডেবারপাড় কাউছার, আলাউদ্দিন, সেলিম ও জুয়েলের গ্যারেজ, রুপাবাদে সামুশু ও নুরুর গ্যারেজ, টেনারী বটতল রফিকের গ্যারেজ, আরেফিনের মুক্তিযোদ্ধা কলোনীতে বিদ্যুত মিজানের গ্যারেজ, আল আামিন মসজিদের পাশে ফুল মিয়া ও আশরাফের বাপের গ্যারেজ, খুলশী পুলিশ বিটের পাশে রাসেলের গ্যারেজ, টেকনিক্যাল, মুজাফ্ফর নগর, সাউদার্ন মেডিকেলের জামাই খোরশেদ ও হেলালের গ্যারেজ সহ টোকেনের বিষয়গুলো এলাকা নিয়ন্ত্রন করেন। চান্দগাঁও, পশ্চিম বাকলিয়া, পাঁচলাইশ, লালখান বাজার, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, দেওয়ানবাজার, শেরশা, বাংলাবাজার, চন্দ্রনগর, জামালখান, দিদার মার্কেট, বাকলিয়া এক্সেস রোড, সৈয়দ শাহ রোড, আমবাগান, বগারবিল রাহাত্তারপুল, পূর্ব বাকলিয়া বলিরহাট, একেখান, ভাটিয়ারী এমন এলাকা বা অলি গলি নেই যেখানে ব্যাটারী রিকসার গ্যারেজ নাই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সমিতির এক সদস্য থেকে জানা যায়, গ্যারেজ মালিকরাও প্রতিদিন গাড়ি প্রতি ১০০ টাকা থেকে ১৩০ টাকা বিল নেন। বায়েজিদের এক গ্যারেজ মালিক সুত্রে জানা যায়, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও চার চাকার ইজিবাইকের ব্যাটারি চার্জে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের খরচ হচ্ছে। সাধারণত একটি ইজিবাইক চালানোর জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন। আর প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৯০০ থেকে ১১০০ ওয়াট হিসেবে পাঁচ থেকে ছয় ইউনিট (দিনে বা রাতে কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা) বিদ্যুৎ খরচ হয়। কিন্তু ৮০ ভাগ গ্যারেজ মিটারের বাইরে লাইন ব্যবহার করে বিদ্যুত চুরি করে ব্যাটারী রিচার্জ করায় সরকার বিদ্যুত খাত থেকে অনেক রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। সেই সাথে নগরজুড়ে বাড়ছে লোডশেডিং এর মাত্রা।

টোকেনের বিষয় জানতে এনুামল হককে মুঠোফোনে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি এখন টোকেনের টাকা নেইনা। তবে আমার গ্যারেজ আছে, প্রায় ২৯টি ব্যাটারী রিক্সা আছে। 

বায়েজিদ টেকনিক্যাল এলাকার টোকেনে টাকা উত্তোলন কারী সামশুকে মুঠোফোনে বলেন, আপনাদের সাঙ্গুর অনেক সাংবাদিকের সম্পর্ক আছে। আমি টাকা তুলতে এখানো কেউ দেখে নাই। টোকেনে টাকা কে তোলে আমি জানিনা। তবে ড্রাইভার বা গ্যারেজের মালিকরা বলে থাকলে মিথ্যা বলছে। 

ব্যাটারী রিকসা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সানাউল্লাহ বলেন, আসলে গড়ে উঠা গ্যারেজের বিষয় নিয়ে আমি কিছু বলতে পারবোনা। কারন পাবলিক যদি গাড়ি নামায়, গ্যারেজ দেয় আমরা কি করতে পারি। এদের উপর সমিতির কোন নিয়ন্ত্রন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে ক্ষেত্রে আমাদের কোন নিয়ন্ত্রন নাই। এর বেশী কিছু বলতে পারবোনা।