ঢাকা, সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ব্রিকসের ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ

অর্থনীতি ডেস্ক: | প্রকাশের সময় : শনিবার ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৭:২০:০০ অপরাহ্ন | অর্থনীতি ও বাণিজ্য

উদীয়মান অর্থনীতির পাঁচটি দেশের জোট হলো ব্রিকস। ব্রিকসের উদ্যোগে গঠিত নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) থেকে প্রথমবারের মতো ঋণ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

 

আগামী নভেম্বরেই দুটি প্রকল্পে ঋণ পাবে বাংলাদেশ।

ব্যাংকটি বিশুদ্ধ পানি সরবরাহসহ আরও একটি প্রকল্পে সাড়ে ৩২ কোটি ডলার দেবে, যা ডলারে বাংলাদেশের বর্তমান বাজারদরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মতো। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ ব্যাংকের ঋণকে স্বাগত জানানো উচিত। এতে বিদেশি ঋণের উৎসে বৈচিত্র্য আসবে। এটি সহযোগিতার ভালো উদাহরণ হলেও ঋণের অর্থ যাতে সঠিকভাবে ব্যবহার হয় এবং এর কোনো অপচয় না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে রিজার্ভের যে অবস্থা তাতে চ্যালেঞ্জের বিষয়টাকে মাথায় রাখতে হবে। ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বৈদেশিক প্রেক্ষাপট না দেখে অভ্যন্তরীণ সামর্থ্য, সুশাসনের মাধ্যমে জনগোষ্ঠীকে এ সুফল দেওয়ার সক্ষমতার বিষয় বিবেচনায় রাখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন তারা।

 

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, এ ঋণপ্রস্তাব অনুমোদনের জন্য এনডিবির বোর্ড সভায় উঠবে। আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যেই এ ঋণ অনুমোদন করা হবে। এনডিবি সদস্য হওয়ার দুই বছরের মাথায় প্রথমবারের মতো ঋণ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ ঋণের সুদের হার দুই থেকে আড়াই শতাংশের মধ্যে থাকবে। এছাড়া বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি), এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি)— এই চার বহুপক্ষীয় ঋণদাতা ব্যাংকের কাছ থেকে নিয়মিতভাবে প্রতিবছর ঋণ নেয় বাংলাদেশ।

 

সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ঋণের বিষয়টি দেখভাল করার জন্য ইআরডিতে একটি নতুন শাখা খোলা হয়েছে। উপসচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা এ শাখার নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

 

এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খান বলেন, আমরা নতুন একটি উৎস ঋণ নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। উৎসটি হলো নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এ ব্যাংকের ঋণে কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা চলছে। এ বিষয়টি শিগগিরই চূড়ান্ত হবে। আশা করছি দুটি প্রকল্পে আমরা ঋণ পাবো। আগামী নভেম্বর মাসে এ বিষয়ে চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর কত টাকা ঋণ পাবো সেটা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না, আলোচনা চলছে। যখন চূড়ান্ত হবে তখন আপনাদের জানানো হবে। তবে আমরা নতুন উৎস থেকে ঋণ পেতে যাচ্ছি এটাই বড় কথা। সময় হলে সব জানতে পারবেন।

 

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা পানি সরবরাহ প্রকল্পে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কাছ থেকে ৩২ কোটি ডলার ঋণ নিতে পারবে বাংলাদেশ। এ প্রকল্পের মোট খরচ ৪ হাজার ১১০ কোটি টাকা। ঢাকা ওয়াসা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। গত ২৯ আগস্ট এ প্রকল্পের ধারণাটি অনুমোদন করেছে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এখন ঋণ প্রস্তাবটি এনডিবি বোর্ডের অনুমোদনের অপেক্ষায়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নতুন যুক্ত হওয়া ১৬টি ইউনিয়নে পানি সরবরাহ–ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হবে। গ্রাহকদের জন্য নতুন লাইন বসিয়ে পানির সংযোগ দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে প্রকল্পটির মাধ্যমে পানির সরবরাহে ৭০ হাজার নতুন সংযোগ দেওয়া হবে।

 

এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পাওয়ার পর ইআরডি সচিব শরিফা খান নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থে নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। যেমন যশোর, পাবনা, নোয়াখালী ও কক্সবাজারে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প। এ প্রকল্প ভারতীয় গুচ্ছঋণে (লাইন অব ক্রেডিট বা এলওসি) বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল। গুচ্ছঋণের আওতায় এ প্রকল্পে ১৮ কোটি ডলার বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় ২০২১ সালের ২২ জুন এলওসির প্রকল্পের তালিকা থেকে এটি বাদ দেওয়া হয়। এখন প্রকল্পটি নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া জামালপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পও আলোচনায় আছে।

 

এবিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমাদের মতো সম্প্রসারণশীল দেশের অর্থনীতির জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণের প্রয়োজন হয়। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে যে আয় হয় সেটা দিয়ে আমাদের বার্ষিক চাহিদা মেটানো কষ্ট হয়। সেজন্য বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে থাকি। সাধারণত যেসব বড় উৎস যেমন বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি), এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি), আইএমএফ এর কাছ থেকে আমরা নিয়মিত ঋণ পাই। এর পাশাপাশি আরও একটি মাল্টি ডেভেলপমেন্ট খাত থেকে ঋণ পাওয়া ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি।

 

তিনি বলেন, আমাদের দেখার বিষয় হচ্ছে আমরা কোন কোন খাতের জন্য ঋণ নিচ্ছি। ঋণের শর্ত কি, যেখাতে ব্যবহৃত হবে সেখান থেকে কি লাভ হবে এ বিষয়গুলো নজরে রাখতে হবে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে রিজার্ভের যে অবস্থা তাতে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা এবং বাস্তবায়ন করার যে চ্যালেঞ্জ সে বিষয়টাকেও মাথায় রাখতে হবে। আমাদের ঋণ নেওয়ার বিষয়টি একমাত্র বিবেচ্য হওয়া উচিত নয়। এ ঋণ যে উদ্দেশ্যে নেওয়া হচ্ছে যেমন, সামাজিক লাভ বা অর্থনৈতিক লাভ হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু সেবিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে। সুতরাং ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বৈদেশিক প্রেক্ষাপট না দেখে অভ্যন্তরীণ সামর্থ্য, সুশাসনের মাধ্যমে যে জনগোষ্ঠীকে এ সুফল দেওয়ার অভিপ্রায় সেটা দেওয়ার মতো সক্ষমতার বিষয় বিবেচনায় রাখার প্রয়োজন আছে।

 

প্রসঙ্গত, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার নামের আদ্যক্ষর নিয়ে জোটটির নামকরণ হয়েছে ব্রিকস। এ জোটের নেতৃত্বে ২০১৪ সালে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) গঠিত হয়। শুরুতে ওই পাঁচ দেশই এনডিবির সদস্য ছিল। পরে ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ এ ব্যাংকের সদস্য হয়। এছাড়া সদস্য হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও মিশর। সব মিলিয়ে ব্যাংকটির সদস্যসংখ্যা এখন আট। লাতিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়ে নতুন সদস্য হওয়ার পথে। গত আগস্টে ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়, আরও ছয় দেশকে জোটের সদস্য হতে আমন্ত্রণ জানানো হবে।

 

জানা গেছে, ব্রিকস হলো উদীয়মান অর্থনীতির পাঁচটি দেশ– ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং সাউথ আফ্রিকার প্রথম অক্ষরের সমন্বয়ে নামকরণ করা একটি জোট। জনসংখ্যা, আয়তন এবং অর্থনৈতিক আকারের দিক থেকে ব্রিকস জোট বর্তমান বিশ্বের একটি বড় শক্তি। ২০১৪ সালের হিসেবে, ব্রিকসের পাঁচটি সদস্য দেশ প্রায় ৩২০ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ। এ পাঁচ দেশ পৃথিবীর ২৫ শতাংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে এবং বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশও এ দেশগুলোর। এমনকি বর্তমানে ব্রিকস সম্মিলিতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ৪৩ শতাংশ (আট ট্রিলিয়ন ডলার) নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বের যত পণ্যসেবা উৎপাদন হয় তার ২১ শতাংশ আসে এ পাঁচটি দেশ থেকে।

 

ব্রিকসের সদস্য দেশগুলো বেশ আগে থেকেই নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন, ব্রিকস মুদ্রা প্রবর্তন এবং নিজস্ব রিজার্ভের কথা বলে আসছে। এটি কার্যকর হলে ব্রিকস দেশগুলো তাদের নিজেদের মুদ্রায় ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারবে। এতে ডলারে নির্ভরতা কমবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।