স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দখল করে নিয়েছিল বর্তমান সিলেট জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি এজাজুল হকের গ্রামের বাড়ি। সে সময় এজাজুল হক ৫ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। হায়েনারা বাড়ি দখল করে নেয়ায় এজাজুল হকের পুরো পরিবার আশ্রয় নিয়েছিলেন অন্যত্র। কয়েক সপ্তাহের মাথায পাকিস্তানি হায়েনাদের পতন ঘটে। দেশ স্বাধীন হয়। দখলদার বাহিনী এজাজুল হকের বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। বাড়িতে ফিরে আসেন এজাজের পুরো পরিবার। এজাজুল হকের গ্রামের বাড়ি সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার থানার আঙ্গুরা মোহাম্মদপুর গ্রামে। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কুশিয়ারা নদী।
এজাজুল হক এজাজ শৈশবের দেখা স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেছেন দৈনিক বায়ান্নের কাছে।
এজাজুল হক জানান, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি স্থানীয় ফাড়িরবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণিতে অধ্যায়ন করতেন। কিশোর বয়সেই পাকিস্তানিদের অন্যায় অবিচারের কথা শুনতেন বাবা ফজলুল হকের কাছ থেকে। প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাস করেও প্রতিদিনের খবর জানার জন্যে এজাজের বাবা ফজলুল হক নিয়মিত রেডিও ব্যবহার করতেন। বিবিসি‘র খবর নিত্যদিন শুনতেন। বুঝতে পারতেন যেকোনো সময় পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের উপর হামলে পড়বে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে বাবা ফজলুল হক রেডিওতে খবর শুনলেন। জানলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর হামলে পড়েছে। বাবার কাছে ওই খবর জেনে বাড়ির সবাই বিচলতি হয়ে পড়লেন। বিশেষ করে এজাজের দাদা আরজদ আলী শঙ্কিত হয়ে পড়েন। কারণ স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন এজাজের বাবা।
তিনি জানান, যুদ্ধ শুরু হওয়ার ২-৩ দিনের মাথায় সংগ্রাম কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় তাঁদের গ্রামের কাঁচা রাস্তা কেটে ফেলার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাস্তা কেটে ফেলা হয়। এতে ওই গ্রামের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইতোমধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী স্থানীয় মুক্তিবাহীনির সহযোগিতায় সিলেট-বিয়ানীবাজার রাস্তা নিয়ন্ত্রণে রাখে। এই অবস্থা অব্যাহত ছিলো ১৫ দিনের মতো। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ হয়। এই গোলাগুলি ছিল ভারতীয় বাহিনীর সাথে পাকিস্তানি হায়েনাদের। পাকিস্তানি যুদ্ধ বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এক পর্যায়ে ভারতীয় মিত্ররা পিছু হটে। চুরখাই এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে পাকিস্তানি সেনারা। এখানে রাজাকারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এই ক্যাম্প থেকে রাজাকারদের সহযোগিতা নিয়ে হানাদার বাহিনী ওই এলাকায় নিরীহ মানুষের উপর বর্বরতা চালাতো। আগুন দিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিত।
এজাজুল হক জানান, জুলাই মাসে তাঁর দাদা আরজদ আলী জানতে পারেন পাকিস্তানিদের রেডলিস্টে তাঁর বাবা ফজলুল হকের নাম। বাবাকে রক্ষা করতে দাদা আরজদ আলী ছোটাছুটি শুরু করেন। রাজাকারদের সাথে যোগাযোগ করেন। রাজাকার নেতা বসন হাজী জানিয়ে দেন ফজলুল হকের নাম রেডলিস্ট থেকে কাটতে হলে ৫০০০ টাকা লাগবে। ওই সময় ৫০০০ টাকা ছিলো বিশাল অঙ্কের টাকা। অঙ্কের পরিমাণ কমানোর অনুরোধ করা হয়। কিন্তু রাজাকাররা জানিয়ে দেয় পুরো ৫ হাজার টাকা দিতে হবে। ওই অবস্থায় দাদা ৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করার কাজ শুরু করেন। সে সময় স্বর্ণের ভরি ছিল ৭০ টাকা। মায়ের সকল স্বর্ণ বিক্রি করে দেয়া হয। এজাজা ও তাঁর বড় ভাই ফুটবল কেনার জন্যে ১২ টাকা জমা করেছিলেন। ওই টাকা দাদার হাতে তুলে দেন। এক রোববারে স্থানীয় বাজারে সবাই চাঁদা সংগ্রহ করেন ফজলুল হককে রক্ষা করার জন্যে। শেষ পর্যন্ত এজাজের দাদা ৫ হাজার টাকা তুলে দিয়েছিলেন রাজাকার বসন হাজীর হাতে। টাকা পেয়ে রাজাকাররা আশ্বস্ত করেছিল ফজলুল হকের আর কিছু হবে না। তালিকা থেকে নাম কেটে দেয়া হবে।
এজাজুল হক জানান, ওই ঘটনার কয়েকদিনের মাথায় পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের বাড়িটি ঘেরাও করে ফেলে। মা ঘর থেকে বের হয়ে পাকিস্তানি সেনা দেখে আবার ঘরে চলে যান। ৭ম শ্রেণিতে পড়ুয়া বড় বোনকে ঘরের পেছন দিক দিয়ে বের করে দেন। ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে কুরআন শরীফ পড়তে শুরু করেন। পাকিস্তানি হায়েনারা ডাকাডাকি করে। কিন্তু দরজা খোলা হচ্ছিল না। এসময় প্রতিবেশি একজন ওই এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি এগিয়ে আসেন। এগিয়ে যান ঘরের দিকে, দরজার দিকে। দরজা খুলতে বলেন। পরিচিত কন্ঠ শুনে দরজা খুলে দেন মা। দরজা খুলে দিয়েই দরজার সামনে বসে পড়েন। পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছে প্রাণ ও ইজ্জত রক্ষার ফরিয়াদ করেন। এসময় মায়ের কোলে থাকা শিশু বোন কেঁদে উঠেন। পাকিস্তানি হায়েনাদের এক অফিসার এগিয়ে এসে বাবার সন্ধান জানতে চান। বাড়িতে নেই জানানোর পরও পাকিস্তানি হায়েনারা মানতে নারাজ। এই বাড়িতে মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র থাকে-এই বলে হায়েনারা পুরো বাড়ি তল্লাশি করে। কিছু না পেয়ে ফিরে যাওয়ার সময় এক সপ্তাহের মধ্যে বাবাকে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে হাজির করতে বলে।
এজাজুল হক বলেন, এক সময় বাবা বাড়ি ফেরেন। অনুমান ২০ দিনের মাথায় রাজাকারদের সাথে নিয়ে রাতের আঁধারে হানাদার বাহিনী আবার অভিযান চালায়। হানাদার বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে মা ঘর থেকে বের হয়ে পাকিস্তানি হায়েনার রাইফেলের নল ধরে ফেলেন। মায়ের সাথে তর্কাতর্কি করে হায়েনারা। বাড়িতে তল্লাশি শুরু করে। এক সময় পেয়ে যায় বাবাকে। বাবাকে নিয়ে হায়েনারা কুশিয়ারা নদী পাড়ি দিয়ে বিয়ানীবাজার ক্যাম্পে চলে যায়। বাবার সাথে আরো ৩ জনকে আটক করে নিয়ে যায়। বাবাকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার সময় ওই এলাকায় রাজাকার বসন হাজীও ছিল। যে কিনা বাবার নাম কাটানোর জন্য ৫ হাজার টাকা নিয়েছিল। তার দিকে দাদা এগিয়ে যেতে চাইলে নিষেধ করা হয় হাত তুলে। ক্যাম্পে নিয়ে টর্চার শেষে বাবাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। এলাকার দুই লোক গিয়ে ওই খবর জানতে পারেন। তারা ফিরে এসে স্থানীয় ফাড়ির বাজারের মানুষজনের কাছে বলার সময় এজাজুল হক শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। একজন এগিয়ে গিয়ে এজাজকে কোলে তুলে নেন। পৌঁছে দেন বাড়িতে। বাবা ফজলুল হকের পরিণতির খবর পান স্থানীয় রাজাকার লিডার সফিক। তার আত্মসম্মানে আঘাত করে এই ঘটনা। কারণ অন্য এলাকার রাজাকেরর কথায় তার নিজ এলাকার কারো প্রাণ যেতে পারে না। সফিক দ্রুত ছুটে যায় ক্যাম্পে। পাকিস্তানি হায়েনাদের বুঝিয়ে মুক্ত করে ফজলুল হককে। রাত বারটায় ফজলুল হককে সাথে নিয়ে ফিরে আসে সফিক রাজাকার।
এজাজুল হক জানান, যুদ্ধের শেষ দিকে হানাদার বাহিনী তাঁদের বাড়ি দখল করে নেয়। ক্যাম্প করার জন্যে বাংকার খনন করতে শুরু করে। ওই অবস্থায় এজাজুল হকের পুরো পরিবার বাড়ি ছেড়ে কুশিয়ারা নদী পাড়ি দিয়ে মাথিউড়ার দিকে রওয়ানা হন। বিশাল হাওর পাড়ি দিয়ে বড় বোনের বান্ধবীর মামার বাড়িতে উঠেন। ওই বাড়িতে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করেন। শেষ দিকে বাবার খালার বাড়িতে আশ্রয় নেন তাঁরা। ১৬ ডিসেম্বর বেলা দেড়টার দিকে জানতে পারেন দেশ স্বাধীন হয়েছে। হায়েনারা আত্মসর্মপন করেছে। এই খবর পেয়ে এজাজের পুরো পরিবার বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নেন। এজাজ বলেন, ওইদিন বড় একটি মোরগ ধরে তাঁদের খাওযানোর জন্যে রান্না করা হয়। খাওয়া শেষে এজাজের পুরো পরিবার বিকেলে ফিরে আসেন বাড়িতে।