ঢাকা, সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

জীবন বিমার অবৈধ ব্যয় বাড়ছেই

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : সোমবার ১৬ মে ২০২২ ১১:১১:০০ পূর্বাহ্ন | জাতীয়

ব্যবস্থাপনা খাতে আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যয় করা অর্থ পুনর্ভরণ (ব্যয় কমিয়ে অতীতের অতিরিক্ত ব্যয় সমন্বয়) করার জন্য ২০১৮ সালে অঙ্গীকার করে বেশ কয়েকটি জীবন বিমা কোম্পানি। তবে পুনর্ভরণ করা দূরের কথা, এখনো অবৈধ ব্যয়ের লাগামই টানতে পারেনি দেশে ব্যবসা করা অর্ধেক কোম্পানি। সবশেষ ২০২১ সালে ১৭টি জীবন বিমা কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করে ব্যয় করেছে ১১৫ কোটি টাকার বেশি অতিরিক্ত অর্থ।

জীবন বিমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা পর্ষদের অদক্ষতা ও পরিচালনা পর্ষদের ব্যর্থতার কারণে এই অবৈধ ব্যয়ের লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না।

 ২০২১ সালে ব্যবস্থাপনা খাতে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করেছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান জীবন বিমা করপোরেশন। এ প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থাপনা খাতে ৪৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে 

তারা বলছেন, ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের যে নিয়মকানুন দেওয়া আছে তা মেনে চললেই ব্যয় আইনি সীমার মধ্যে চলে আসবে। কিন্তু কোনো কোনো কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পর্ষদ ইচ্ছা করেই ব্যবস্থাপনা ব্যয় সীমার মধ্যে নিয়ে আসছে না। এক্ষেত্রে সঠিকভাবে তদারক করতে পারছে না পরিচালনা পর্ষদও। ফলে ব্যবস্থাপনা খাতে সীমার বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে।

অন্যদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) বলছে, জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয় যাতে সীমার মধ্যে থাকে সেজন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেসব বিমা কোম্পানি ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেছে তাদের জরিমানা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের কাছ থেকে মুচলেকা নেওয়া হয়েছে, আগামীতে কোনোভাবেই সীমার অতিরিক্ত অর্থ ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় করা যাবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জীবন বিমা কোম্পানিগুলো আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা খাতে অবৈধভাবে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করায় পলিসিহোল্ডার ও শেয়ারহোল্ডার উভয়েই তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কারণ অতিরিক্ত যে টাকা ব্যয় হচ্ছে তার ৯০ শতাংশই প্রতিষ্ঠানের পলিসিহোল্ডারদের প্রাপ্য। বাকি ১০ শতাংশের ভাগিদার শেয়ারহোল্ডাররা।

জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে পলিসিহোল্ডার ও শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ২০১৬ সালে প্রথমবার সবকটি কোম্পানিকে শুনানিতে ডাকে আইডিআরএ। শুনানিতে ভবিষ্যতে ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করা হলে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে কোম্পানিগুলোকে সতর্ক করা হয়। একই সঙ্গে অতীতে যে পরিমাণ অর্থ অতিরিক্ত খরচ করা হয়েছে তা সমন্বয় করতে নির্দেশ দেওয়া হয় ক্রমান্বয়ে।

 একসময় ফারইস্ট ইসলামী লাইফ, পপুলার লাইফ, ন্যাশনাল লাইফ, প্রগতি লাইফ, মেঘনা লাইফ, সন্ধানী লাইফ, ডেল্টা লাইফের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতো। এখন এই কোম্পানিগুলোর ব্যয় সীমার অনেক নিচে চলে এসেছে 

সে সময় আইডিআরএ’র তৈরি করা প্রতিবেদনে উঠে আসে, ১৭টি জীবন বিমা কোম্পানি ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা খাতে ১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত খরচ করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে করা অতিরিক্ত ব্যয়ের পেছনে কী ধরনের দুর্নীতি হয়েছে তা খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

তবে এরপরও ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব না হলে ২০১৮ সালে আবার জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বসে আইডিআরএ। সে সময় ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় করা অতিরিক্ত অর্থ পুনর্ভরণ করার অঙ্গীকার করে জীবন বিমা কোম্পানিগুলো। এরপরও অতিরিক্ত ব্যয় বন্ধ না হওয়ায় গত বছর জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর মাঠ পর্যায়ের সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস করে আইডিআরএ।

এতে কোম্পানিগুলোর সুপারভাইজরি লেভেলে পাঁচটি গ্রেডের পরিবর্তে তিনটি গ্রেড রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই তিন গ্রেডের জন্য বেতন-ভাতা, কমিশন, বোনাস ও যাতায়াতসহ সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ খরচের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। অবশ্য এরপরও জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর এই অবৈধ ব্যয় থামেনি।

সবশেষ ২০২১ সালে ১৭টি জীবন বিমা কোম্পানি ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেছে ১১৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। আগের বছর (২০২০ সাল) এ খাতে অতিরিক্ত ব্যয় ছিল ১১৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে ব্যবস্থাপনা খাতে জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর অবৈধ ব্যয়ের পরিমাণ বেড়েছে।

আইন লঙ্ঘন করে ২০২১ সালে ব্যবস্থাপনা খাতে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করেছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান জীবন বিমা করপোরেশন। এ প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থাপনা খাতে ৪৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। এর পরের স্থানেই রয়েছে গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্স। এ প্রতিষ্ঠানটি অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ১২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ১১ কোটি ৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করে তৃতীয় স্থানে রয়েছে সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স।

বাকি ১৪টি কোম্পানি এককভাবে ১০ কোটি টাকার কম অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। এর মধ্যে প্রোগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স ৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ৬ কোটি ৩৮ লাখ, মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ৫ কোটি ৫৩ লাখ, পদ্মা ইসলামী লাইফ ৪ কোটি ৭০ লাখ, বেঙ্গল ইসলামী লাইফ ৪ কোটি ৪৩ লাখ, যমুনা লাইফ ৩ কোটি ৩০ লাখ এবং চার্টার্ড লাইফ ৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে।

এছাড়া এলআইসি বাংলাদেশ ২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, বেস্ট লাইফ ২ কোটি ২০ লাখ, ডায়মন্ড লাইফ ১ কোটি ৯৯ লাখ, জেনিথ ইসলামী লাইফ ১ কোটি ৮০ লাখ, প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফ ১ কোটি ২৬ লাখ, এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্স ১ কোটি ২২ লাখ ও আকিজ তাকাফুল লাইফ ইন্স্যুরেন্স ১ কোটি ৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে।