ঢাকা, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২৩শে মাঘ ১৪৩১

বহুমুখি সংকটে দেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান মোবারকগঞ্জ চিনিকল

বসির আহাম্মেদ, ঝিনাইদহ : | প্রকাশের সময় : রবিবার ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৩:৩৪:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর

বহুমুখি সংকট নিয়ে চলছে দেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের অন্যতম ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ মোবারকগঞ্জ চিনিকল। বর্তমানে মিলজোন এলাকায় বিগত বছরের চেয়ে আখ চাষ কম হওয়ার কারণে চিনি উৎপাদন কমেছে। যার কারণে দেশের বাজারে চিনির দাম বেড়েছে।

চাষিরা আখ চাষ বাদ দিয়ে অন্য চাষ আবাদের দিকে ঝুকে গেছে। আখের অভাবে গেলো মাড়াই মৌসুমে (২০২২-২৩) অর্থবছরে (মাত্র ২৮ দিন) সবচেয়ে কমদিন মিলে আখ মাড়াই চলে। ফলে চিনি উৎপাদন কমেছে। বাজার আখ থেকে তৈরি চিনির কদর অনেক।

কিন্তু আখের চিনি টাকা দিয়েও মিলাতে পারছেনা সাধারণ ক্রেতারা। বর্তমানে চিনিকলটি নানা সমস্যায় জর্জরিত ও বহুমুখি সংকটে ভুগছে। সরকার দেশীয় কৃষির সব বিভাগে উন্নয়ন করতে ভর্তুকিসহ নানা পদক্ষেপ নিলেও চিনিকলগুলো যেন অবহেলিত রয়ে গেছে।

ফলে বহুমুখী সংকট আর সমস্যা নিয়ে চলছে ঝিনাইদহের মোবারকগঞ্জ চিনিকল টি। এ মাড়াই মৌসুমে মিলটি চিনি উৎপাদন করে ১ হাজার ৭৪৫ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ হাজার ৩৩৬ মেট্রিক টন ও ২০২০-২১  মৌসুমে মিলটি চিনি উৎপাদন করে ৭ হাজার ৮৬২ মেট্রিক টন। ২৩ ডিসেম্বর এ মিলে চলতি মৌসুমের ( ২০২২ - ২০২৩ ) চিনি উৎপাদন শুরু হয়। ২৫ ডিসেম্বর ভোরে মিলের পাওয়ার টারবাইনে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা যায়।

2-520

ফলে মিল বন্ধ হয়ে যায়। ২৭ ডিসেম্বার আবার মিল চালু হয়। ৬০ হাজার ৬৯০ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৫ হাজার ৭৪৭ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়। মাড়াই কাল ধরা হয়েছিল ৯০ দিন। ২৮ দিন চলার পর আখের অভাবে ১৯ জানুয়ারি মিল বন্ধ হয়ে যায়। ৩৫ হাজার ৩৬০ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে এক হাজার ৭৪৫ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে এর লক্ষ্যমাত্রা আছে ৫৫হাজার মেট্্িরক টন।

 

গত অর্থ বছরে মিলটিতে ক্ষতির পরিমান ছিল ঋণের সুদ বাদে ২৬ কোটি ৩৮ লক্ষ টাকা। এবং ঋণের সুদ পরিশোধ করেছে ৪২ কোটি ৩৯ লক্ষ। সব মিলে অর্থ বছরে ক্ষতির পরিমান দাড়ায় ৬৮ কোটি ৫১লক্ষ টাকা। সার্বিক খরচ নির্বাহ করে  ১কেজি চিনি উৎপাদনে মোট ব্যয় হয় ১৮৫ টাকা সেখানে সরকারী ভাবে বিক্রয় মূল্য ১০০টাকা।


বর্তমানে মিলের প্রধান কাঁচা মালা  আখের দাম প্রতি মণ ১’শ ৮০ টাকা করা হয়েছে। এ দামে আখ বিক্রি করে চাষিদের লাভ হচ্ছে না। আখ ১ বছরের ফসল। আখের চেয়ে অন্য ফসলের চাষ লাভজনক হওয়ায় চাষিরা সে দিকে ঝুঁকেছে। এতে দিনে দিনে মিলজোন এলাকায় আখের আবাদ কমছে। বর্তমানে সময়ে সবকিছুর দাম বেশি হলেও তুলনা মূলক আখের দাম কম। সেইসাথে বাজারে সাদা চিনির দাম বেড়ে প্রায় ১৪০/ ১৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

 

কিন্তু আখ থেকে উৎপাদনকৃত চিনির দাম সরকারি দাম ১০০ শত টাকা। তাই আখের চিনি উৎপাদন বেশি করতে হলে আখ প্রয়োজন। কৃষকেরা বলছে আখের দাম প্রতিমন ২৫০/৩০০শত টাকা হলে আখ রোপন করবে। তাই সরকারের কাছে তারা দাম বৃদ্ধির ঘোষণা জরুরি ভাবে বাস্তবায়নের জন্য আবেদন জানিয়েছেন।


মিলের শ্রমিকরা বলছেন, মান্ধাতার আমলের কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে চিনি। লোকসান কমিয়ে লাভের মুখ দেখতে হলে কারখানার যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন জাতের আখ রোপন করে আখ চাষ বৃদ্বি করা। দীর্ঘদিনের জমে থাকা মোটা অংকের ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফ ও বিকল্প শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে হবে।


অন্যদিকে, চিনি উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রমিকদের মজুরি খরচ, আখ ক্রয়, পরিবহন খরচ, কারখানা মেরামত এবং বয়লারের জ্বালানিসহ অর্ধশতাধিক খাতের খরচ মিটিয়ে প্রতি বছরই বাড়ছে চিনি উৎপাদন খরচ। সে তুলনায় বাড়ছে না চিনির দাম। এদিকে ব্রিটিশ আমলের যন্ত্রাংশে মেরামতসহ ব্যবস্থাপনা বাবদ প্রতি বছরই বাড়ছে জ্বালানিসহ অন্যান্য খরচ। বর্তমান প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মকর্তা, স্থায়ী শ্রমিক ও কর্মচারী রয়েছে ৩’শ ৬৪ জন, তাছাড়া মৌসুমী শ্রমিক ৩,শ ৪১ জন এবং ৪৪ জন চুক্তি ভিত্তিক শ্রমিক রয়েছে।

এই কর্মকর্তা ও শ্রমিক কর্মচারীদেও মাসিক বেতন দিতে হয়  ১ কোটি ৪৩ লক্ষ থেকে  ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার মত।  এই খরচ নির্বাহ করে প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখতে গেলে আখের উৎপাদন বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই।
এছাড়া মিলের উৎপাদনকৃত চিনি সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসারবাহীনিরা তাদের  রেশন থেকে পাওয়ার জন্য চাহিদা বেড়েছে। বেশির ভাগ চিনি মিল থেকে  তারা আগেই টাকা জমা দিয়ে কিনে নিয়েছে।

অপর দিকে মোচিক শ্রমিক- কর্মচারিরা ও কর্মকর্তারা মাসে সরকারি দামে আগে প্রতি মাসে প্রতিজন ৫ কেজি চিনি ক্রয় করতে পারতো,কিন্তু বর্তমানে চিনি উৎপাদন কম হওয়ার কারণে মাত্র ৩কেজি ক্রয় করতে পারবেন। বর্তমানে কৃষকরা ঈ-৩৭, ঈ-৩৪, ঈ-১৬ ও ২৬ এবং বিএসআরআই-(ইঝজও-অঐক)-৪৬, ৪৫ জাতের আখ বেশি উৎপাদন হয় বলে মিলটির উৎপাদন ও বিপণন বিভাগ জানিয়েছেন।


চিনিকল সূত্রে জানা গেছে, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা শহরে ১৯৬৫ সালে ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০৭ দশমিক ৯৩ একর নিজস্ব জমির ওপর নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতায় মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মধ্যে ২০ দশমিক ৬২ একর জমিতে কারখানা, ৩৮ দশমিক ২২ একর জমিতে কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক কলোনি, ২৩ দশমিক ৯৮ একর পুকুর এবং ১,শ ৭ একর জমিতে পরীক্ষামূলক ইক্ষু খামার করা হয়।

এছাড়া ১৮ দশমিক ১২ একর জমিজুড়ে রয়েছে সাবজোন অফিস ও আখ ক্রয়কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠাকালীন মৌসুমে পরীক্ষামূলকভাবে ৬০ কর্মদিবস আখ মাড়াই চলে। লক্ষ্যপূরণ হওয়ায় ১৯৬৭-৬৮ মাড়াই মৌসুম থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। ঝিনাইদহের ছয় উপজেলা ছাড়াও যশোরের দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত মিলে আটটি জোনের আওতায় চাষযোগ্য জমির পরিমাণ সাড়ে তিন লাখ একর। আখ ক্রয় কেন্দ্র রয়েছে ৪৮টি।

স্থানীয় কৃষক, কর্মচারী এবং শ্রমিকরা জানিয়েছেন দক্ষিন-পশ্চিমবঙ্গের এই বৃহৎ চিনি শিল্পের উপর ৪/৫ লক্ষ লোকের রুটি রুজি নির্ভর করে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
মোবারকগঞ্জ চিনিকল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি গোলাম রসুল বলেন, সরকার যদি আখের দাম বাড়ায় তাহলে আশাকরি কৃষকরা আখ চাষ বৃদ্ধি করবে। কাচা মাল উৎপাদন বাড়লে আমরা মিলকে ভাল আবস্থায় নিয়ে যেতে পারবো।


প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক (অর্থ) মোঃ জাহিদুল ইসলাম বলেন, আখের উৎপাদন এবং মূল্য বাড়লে এই ক্ষতি অনেকটা কাটিয়ে উঠা যাবে। তিনি আরও বলেন গত অর্থ বছরে ৬০হাজার মেট্রিক টন আখ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থাকলে সেখানে মাত্র ৩৫ হাজার ৩’শ ৬০মে.টন আখ উৎপাদন হয়েছে। এবছর ৩ হাজার ১ একর জমিতে আখ চাষ হয়েছে যাতে এবছরেও লক্ষ্যমাত্র পূরণ হবে না। কিছু ক্ষতি থাকবে, সরকারী ভাবে কৃষকদের আর্থিক প্রনোদনা দিলে এবং আখের দাম বৃদ্ধি করলে এই কৃষক আখ চাষ বাড়িয়ে দিলে এই ক্ষতি আস্তে আস্তে কমে আসবে।


মিলের অব্যাহত লোকসান প্রসংগে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, সরকারী ভাবে দাম বৃদ্ধি করলে কৃষকরা আখ চাষে উদ্বুদ্ধ হবে তখন বেশি বেশি আখ পাওয়া যাবে ফলে উৎপাদন খরচ কম হবে এবং লোকসান আস্তে আস্তে কমে যাবে। তাছাড়াও লোকসান কমাতে হলে সরকারকে আখ চাষে ভর্তুকি এবং আখের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানাবিধ সুযোগ সুবিধা প্রদান করতে হবে। মূলত: আখের উৎপাদন বাড়লে চিনি উৎপাদন ব্যয় কমে যাবে এবং প্রতিষ্ঠানের লোকসান কাটিয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিনত হবে।