বান্দরবানের রুমা উপজেলায় অবস্থিত কেওক্রাডং পাহাড়েরর চূড়া থেকে পশ্চিম দিকে কয়েক ফুট নিচে নেমে দক্ষিন দিকে যে পথ গেছে, সেই আকাঁবাকাঁ পাহাড়ী মেটো পথ ধরে কয়েক মিনিট হেটে গেলেই চোখে পড়বে এই গ্রামটি। গ্রামটি বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম বলে পরিচিত। গ্রামটির প্রবেশ দ্বার কাঠ-বাঁশ ও বেড়া দিয়ে আটকানো। প্রবেশের জন্য বানানো আছে একটি ফটক। বাংলাদেশের অন্যতম উঁচু পর্বত শৃঙ্গের চূড়া থেকে নেমে যে গ্রামটি দেখা যায় তার নাম পাসিং পাড়া।
দেশের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত স্বাদু পানির হ্রদ বগালেকের পরবর্তী স্থান কেওক্রাডং। শীর্ষ এ পর্বতচূড়ায় পৌঁছানোর পর হাতছানি দিয়ে ডাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম পাসিংপাড়া।রুমা উপজেলা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে কেওক্রাডং পাহাড় অবিস্থত। যাত্রাপথ অত্যন্ত দুর্গম ও কষ্ঠসাধ্য বলে অনেকে অর্ধেক গিয়ে আবার ফিরে আসে। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা পাসিংপাড়ার দৃশ্য খুবই মনোরম। এত উঁচুতে বাংলাদেশের আর কোনো গ্রাম নেই। কথিত আছে, গ্রামটির পাড়া প্রধান বা কারবারি পাসিং ম্রো-এর নামে এর নামকরণ করা হয় "পাসিংপাড়া "। পাড়ার বাসিন্দারা মূলত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মুরং সম্প্রদায়ের লো।
পাসিং ম্রো পাড়ার বৈশিষ্ট্য হলো- আপনি ঘরের সামনে বা মাচার উপর দাঁড়িয়ে মেঘ স্পর্শ করতে পারবেন। চাইলে হা করে মেঘ গিলে নিমেষেই শরীরের ভেতরটা শীতলও করতে পারবেন। প্রায় সারা বছরই মেঘের ভেতরে থাকে পাসিংপাড়ার অধিবাসীরা। আশপাশের সব চরাচর দেখে মনে হয় যেন এক মেঘের সমুদ্র।
পাসিং ম্রো পাড়ায় মেঘ আপনার চারপাশ দিয়ে খেলা করবে,উড়ে বেড়াবে যখন-তখন। মেঘেরা হাতের কাছে এসে জড়িয়ে ধরে টেনে নিয়ে যেতে চাইবে তাদের দলে। সবকিছু মিলিয়ে যেন মেঘের ওপর ভেসে থাকা এক গ্রামের নাম পাসিংপাড়া। পাসিংপাড়ায় ৫০-৬০টি মুরং পরিবারের বাস। মূলত জুম চাষ তাদের অর্থনীতির প্রধান জোগান। ঘরের বেড়ায় বাঁশের আধিক্য থাকলেও ছাউনিতে রয়েছে টিন। গ্রামটি অন্যান্য মুরংপাড়ার মতোই সুন্দর। বেশি উচ্চতায় বসবাস হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই এ পাড়ার মানুষ এত উপরে পানি পায় না। পানির জন্য প্রতিদিন তাদের নামতে হয় অন্তত দুই হাজার ফুট নিচে ঝিরিতে। এদের জীবনযাত্রার এমন সংগ্রামের কথা অনেকেরই অজানা।
বেশি উচ্চতায় হওয়ায় বাতাসের তাণ্ডব থেকে বাঁচার জন্য পাসিংপাড়ার টিনের চালগুলো আটকে রাখতে উপরে বাঁশ আড়াআড়ি করে বাঁধা হয়। পাড়ার ঠিক মাঝবরাবর একটা রাস্তা চলে গেছে। দুপাশে ঘর। মনে হয় যেন একটা বাজার! পাড়ায় বসবাসকারী সবাই খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের। পাসিংপাড়ার চার্চটি খানিকটা পাহাড়ের উপরে। প্রতি রোববার এখানে ধর্মীয় সমাবেশ ও প্রতি সন্ধ্যায় প্রার্থনা হয়।
পাসিংপাড়া থেকে দূরে, বহুদূরে যেসব পাহাড়শ্রেণি দেখা যায়, সেগুলো দেখতে যে কী অপূর্ব লাগে, যারা দেখেননি তারা বুঝতেই পারবেন না! পাসিংপাড়ার সৌন্দর্য দেখতে চাইলে বান্দরবান শহর থেকে অটোযোগে প্রথমে যেতে হবে রুমা বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে রুমা বাজারের উদ্দেশে দু-তিনটি পরিবহনের বাস সময় ধরে ছেড়ে যায়। রুমা ১নং সদরঘাটে বাস থেকে নেমে সোজা হাঁটলে পড়বে বড়শিপাড়া। সেখান থেকে চান্দের গাড়িতে এগারো মাইল (এলাকার নামক স্হানে যেতে হবে) এরপর তিন ঘণ্টার ট্রেকিংয়ে পৌঁছাতে হবে বগালেক। এ পথেই শীর্ষ চূড়া কেওক্রাডং পৌঁছানোর পর একই রাস্তা ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেলিপ্যাড অতিক্রম করে দেশের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম পাসিংপাড়ায় যেতে হয়।
এই গ্রামটিতে এখন আর পর্যটকরা যেতে পারে না,এখানে বাহিরাগতদের প্রবেশ অধিকার নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। যদিও এক সময় এখানে অনেকে পর্যটক আসতেন।নিরাপত্তাজনিত কারণে এখন সেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ।
আমাদের দেশে এতো উঁচুতে আর কোন গ্রাম নেই। তাই পাসিং পাড়াকেই দেশের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গ্রামটির কারবারি বা পাড়া প্রধান পাসিং ম্রোর নাম অনুসারে এই গ্রামের নাম পাসিং পাড়া হয়েছে। এই গ্রামে বাস করে ৫০ থেকে ৬০টি পরিবার।
আগে এই গ্রামে পর্যটকরা বেড়াতে আসতে পারলেও এখন আর সেই সুযোগ নাই। গ্রামে পর্যটকদের প্রবেশ অনুমতি নেই। পর্যটকদের নিরাপত্তার অভাবের কথা বলেই এই গ্রামে প্রবেশ নিষেধ করা হয়েছে। তাই গত কয়েক বছর যাবৎ পর্যটকদের কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় এসে থেমে যেতে হয়। মাত্র একশো ফুট নিচেই ছবির মতো সুন্দর এই গ্রামে তারা আর যেতে পারেন না।
এই গ্রামের মানুষ খুবই সহজ-সরল এবং পরিশ্রমী। তারা জীবিকার জন্য মূলত জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। কেউ কেউ শিকারও করেন। মেনদ্রো ম্রো, ৭০ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ এই গ্রামের প্রবীণদের একজন। তিনি এক সময় বিজিবিতে কর্মরত ছিলেন। ম্রো জাতির জন্য ক্রামা ধর্মের প্রবর্তন করেছিলেন মেনলে ম্রো। মাত্র ৩৫ বছর আগে এই জনপদে ক্রামা নামে নতুন একটি ধর্মের আর্বিভাব হয় ম্রো বর্ণমালাসহ! ম্রো সম্প্রদায়ের অনেক মানুষই এই ধর্মের অনুসারী। পাসিং পাড়ার ৩ ভাগের দুই ভাগ মানুষই ক্রামা ধর্মের অনুসারী। বাকিদের ভেতর অর্ধেক খ্রিস্টান এবং অর্ধেক বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। মেনদ্রো গ্রামের ক্রামা ধর্মের ধর্মগুরু। ছোট একটি প্রার্থনালয়ও আছে তাদের।
ম্রো সমাজে জুম চাষ শেষ হলে যখন কাজ থাকে না তখন গ্রামের বৃদ্ধরা গল্প শোনায় শিশু-কিশোর-তরুণদের। এই গল্প শুধু রূপকথাই না, এই গল্পে গল্পে মূলত সামাজিক শিক্ষা দিয়ে থাকেন। ম্রো সমাজের অনেক রীতিনীতি সংস্কৃতি উঠে আসে এইসব গল্পে। গ্রামের এই গল্প কথক বৃদ্ধদের অনেকটা সামাজিক শিক্ষক বলা যায়। মেনদ্রো ম্রো তেমনই একজন। যদিও এখন আগের চেয়ে কমে গেছে এসব গল্প বলার প্রচলন।
সুন্দর ছিমছাম গোছানো পরিচ্ছন্ন একটি গ্রাম! এখানে বারো মাসই মেঘ ঘুরে বেড়ায়। উঠানে শিশুরা খেলে সাথে খেলে মেঘও, মেঘের সাথে রয়েছে তাদের নিত্যদিনের বন্ধুত্ব। মেঘ এই পাড়ার অতিথি না, সহবাসিন্দা। প্রতিবেশী। এক সাথেই থাকেন তারা! চারিদিকে সবুজ পাহাড় আর পাহাড়। ওই সব পাহাড়ে আছে নানা রকম বন্য প্রাণী। গ্রামের কেউ কেউ গোদা বন্দুক নিয়ে মাঝে মাঝেই শিকারে যায়। মুহূর্তে মুহূর্তে দৃশ্যের জন্ম হয় এখানে।