বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে টার্গেট করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে মানবপাচারকারী চক্র। আর এই চক্রের মূল টার্গেট হলো রোহিঙ্গা নারী। সমুদ্রপথে সহজে পাচারের জন্য কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরকে বেঁচে নিয়েছে তারা। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও স্থানীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, গত ২২ মার্চ সাগরপথে পাচারকালে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে ১৪৯ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ৭৮ জন নারী, ২৩ জন শিশু ও ৪৮ জন পুরুষ রয়েছে। মূলত দালাল চক্র উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবির থেকে তাদের জড়ো করে পাচার করছিল। আর এই কারণে দালালরা তাদের কাছ থেকে ৪০-৫০ হাজার টাকা করে নিয়েছে।
এরপর গত ২৪ মার্চ কক্সবাজার র্যাব-১৫ বঙ্গোপসাগরের টেকনাফের শামলাপুর উপকূল থেকে আরও ৫৭ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুকে উদ্ধার করে। এ সময় র্যাব দুজন দালালকে গ্রেপ্তার করে। গত বছরের মে মাসে আরও ৩০৬ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়া সম্প্রতি ভারতে পাচারকালে সাতজন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে র্যাব। এ ঘটনায় দুই দালালকেও আটক করা হয়।
সরেজমিনে উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা প্রতিবেদকের। তারাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে তাদের বিরুদ্ধে ভয়ে কথা বলতে পারছেন না তারা। টেকনাফ-উখিয়ার ৩৪টি ক্যাম্পের প্রতিটিতে ওই চক্রের সদস্যরা ছদ্মবেশে আত্মগোপনে রয়েছে বলে জানান তারা।
জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে দেড় হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়েছে, যা ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া মানুষের তুলনায় প্রায় ৫০ গুণ বেশি। ২০১৫ সালে সমুদ্রযাত্রীদের বেশিরভাগই ছিল পুরুষ। কিন্তু ২০১৮ সালের সমুদ্রযাত্রীদের শতকরা ৫৯ ভাগই নারী ও শিশু। গত বছরের চিত্র আরও ভয়াবহ।
জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম বিভিন্ন সময় কাজ করতে গিয়ে ২০১৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত প্রায় ৬৩৩ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছেন এবং তাদের নিয়ে কাজ করেছেন। তাদের হিসেব অনুযায়ী, গত তিন বছরে ৪৫ শতাংশ অর্থাৎ ৩৪৮ জন রোহিঙ্গা ভুক্তভোগী ছিলেন।
টার্গেট মালয়েশিয়া
বাংলাদেশের পর রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ অবস্থান করছে মালয়েশিয়া। সেখানেই টার্গেট করে রোহিঙ্গাদের পাঠানোর চেষ্টা করে দালালরা। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের। বিভিন্ন সময় সাগরপথে পাড়ি দিতে গিয়ে উদ্ধার হওয়া বেশির ভাগ মানুষ বলছেন, তাদের অনেক স্বজন রয়েছে মালয়েশিয়াতে। আর এসব স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেই তারা বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো থেকে বের হচ্ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, মালয়েশিয়াতে গিয়ে রোহিঙ্গারা নানা নির্যাতনের শিকার হন।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেয়ের বিয়ে দিতে এবং বাংলাদেশের ক্যাম্পের চেয়ে আরও ভালো থাকার জন্য তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেন। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মানব পাচারকারী চক্রগুলো রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা নারীদের।
ওই মাঝি বলেন, কোথাও আমাদের কেউ নেই। কিন্তু আমাদের এখানে (ক্যাম্পে) কিছু দালাল আছে। যারা স্থানীয় দালালদের সঙ্গে মিশে রোহিঙ্গা নারীদের রাজি করানোর চেষ্টা করে। তাদের নানা প্রলোভনও দেখানো হয়। যেহেতু আমরা এখানে খুব কষ্টে থাকি, সবাই চায় একটু ভালো জায়গায় থাকতে। ফলে রোহিঙ্গারা সহজে রাজি হয়ে যায়।
জানা গেছে, পাচারকারীরাও অতি সহজে রোহিঙ্গাদের পাচারে রাজি করাতে পারে বলে তাদের সবচেয়ে নিরাপদ মনে করে। রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে টাকা নিতে পারলে ফেরত দেওয়ার ঝুঁকিও থাকে না। পাচারকারীদের লাভও হয় অনেক বেশি।
২২ মার্চ ১৪৯ জন রোহিঙ্গা মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের চর এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নাছিমা আকতার নামে এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত এক রোহিঙ্গা যুবকের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমার পাসপোর্ট করার কোনো সুযোগ না থাকায় স্বামী সাগর পথে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য প্রথম দফায় দালালদের ৩০ হাজার টাকা দিয়েছি।
বালুখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নারী খদিজা বেগম বলেন, আমার বিয়ে হয়েছে ১০ বছর আগে। কিন্তু গত সাত বছর ধরে স্বামী মালয়েশিয়ায় থাকেন। আট বছরের এক মেয়েকে নিয়ে মালয়েশিয়া নেওয়ার চেষ্টা করেন আমার স্বামী। ট্রলার দুর্ঘটনায় আমি প্রাণে বাঁচলেও আমার মেয়েটিকে বাঁচাতে পারিনি। তার সঙ্গে এক ননদকেও হারিয়েছি আমি।
উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের ফাতেমা বলেন, এক বছর আগে বিয়ে করে স্বামী মালয়েশিয়ায় চলে যায়। এখন আমাকেও সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য দালালদের মাধ্যমে সব কিছু ঠিক করেছিলেন। স্বামীর কথায় আমি বাধ্য হয়ে ট্রলারে উঠি।
দেখানো হয় বিয়ের প্রলোভন :
টেকনাফ-উখিয়ায় ৩০টির বেশি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়ে আছেন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা। যারা মিয়ানমারে নানা অত্যাচার, নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। কিন্তু এসব পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অবিবাহিত নারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। যারা ক্যাম্পের অভ্যন্তরেও নিজেদের মধ্যে ধর্ষণ, হত্যাসহ অনেক অপরাধে ভুক্তভোগী।
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের সাহিদা বেগম নামে এক নারী বলেন, আমার চার মেয়ে নিয়ে খুব যন্ত্রনায় আছি। ঘরের বেড়া বাঁশ ও বেত দিয়ে বানানো। ফলে ছিদ্র ও ফাঁকা রয়েছে। এসব ছিদ্র ও ফাঁকা ঘরে বখাটেরা নানা সময় উৎপাত করে। ঘরে মেয়েদের রাখা খুব কঠিন। তাছাড়া আমাদের যেসব খাবার দেওয়া হয়, সেগুলো খেয়ে বেঁচে থাকাও কঠিন। খুব খারাপ জীবযাপন করছি।
উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে জানা গেছে, সাহিদার মতো অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী তার পরিবারের নারী সদস্যদের নিয়ে বিপাকে আছেন। শরণার্থী শিবিরে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন নারীরা।
পাচারের নানা কৌশল :
এক সময় স্থানীয় বাংলাদেশিদের টার্গেট করলেও পাচারকারীরা এখন টার্গেট করছে রোহিঙ্গাদের। এখন দালাল চক্রের সদস্যদের মূল টার্গেট থাকে ক্যাম্পগুলো। বছর খানেক আগেও নারী-পুরুষ উভয় টার্গেট থাকলেও, পাচারকারী চক্রের সদস্যরা সাম্প্রতিক সময়ে নারীদেরকেই টার্গেট করছে। বিশেষ করে এসব নারীদের বিয়ের কথা বলে মালেয়শিয়ায় পাঠানোয় মূল টার্গেট তাদের।
মূলত রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে মাস তিনেক বোঝানো হয়। তাদের পরিবারে মাসে দুই-তিন বার যাতায়াত করা হয়।দেখানো হয় নানান প্রলোভন। রাজি হলে দিনক্ষণ ঠিক করে, ছোট ছোট দলে ভাগ করে আলাদাভাবে এনে এক জায়গায় জড়ো করা হয়। এরপর ছোট ছোট নৌকায় করে গভীর সাগরে পাঠানো হয়। সেখানে থেকে নিয়ে তুলে দেওয়া হয় বড় জাহাজে।
যে কারণে মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গা নারীর চাহিদা :
জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এই তথ্যের বাইরেও আরও তথ্য বলছে, প্রায় দুই লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে দেশটিতে। কিন্তু সেখানে রোহিঙ্গা নারীর সংখ্যা খুবই কম। ফলে মালয়েশিয়ায় বসবাসরত পুরুষ রোহিঙ্গারা বিয়ে করতে পারছে না বলে জানিয়েছে উখিয়া ক্যাম্পের কয়েকজন রোহিঙ্গা মাঝি। তাছাড়া সেখানকার স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করতেও পারছে না তারা। ফলে সেখানে রোহিঙ্গা নারীর সংকট তৈরি হয়েছে। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে দালাল চক্রের সদস্যরা ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে নারীদের প্রলোভন দেখাচ্ছে। আর এই প্রলোভনে পড়ে তারা মালয়েশিয়ায় যেতে চায়।
তবে অভিযোগ রয়েছে, এসব নারীরা বিয়ের পর সেখানে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না। তাদের কোনো কাজেও যেতে দেওয়া হয় না।
লেদা ক্যম্পের মাঝি নুর মোহাম্মদ জানান, মালয়েশিয়ায় বাল্যবিয়ে হওয়া অল্প বয়সী রোহিঙ্গা নারীদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। গৃহবন্দী হয়ে দাসত্বের মতো তাদের জীবন-যাপন করতে হয়।
টেকনাফ ২২ নং ক্যাম্পের হেড মাঝি রফিক বলেন, পাচারকারীরা খুব চালাক প্রকৃতির হয়। তারা নানা সময় নানা পন্থা অবলম্বন করে। প্রথমে তারা সাম্পান আকারের ছোট নৌকায় তুলে তীর থেকে লোকজনকে সাগরে নিয়ে মাছ ধরার ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলারে তুলে দেয়। এসব নৌকা সাধারণত সাগরে জাল দিয়ে মাছ ধরতে যায়। সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ অতিক্রম করে আকিয়াব উপকূলের কাছাকাছি থাকে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াগামী বড় জাহাজগুলো। মালয়েশিয়াগামী লোকজনকে পাচারকারীরা মাছ ধরার নৌকা থেকে বড় জাহাজে তুলে দেয়।
পাচারে ব্যবহার হচ্ছে যেসব পয়েন্ট :
রোহিঙ্গাদের বিদেশ পাচারের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় টেকনাফ ও উখিয়ার বেশ কয়েকটি পয়েন্ট। পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার মতে, শামলাপুর, শীলখালি, রাজারছড়া, জাহাজপুরা, সবারাং, শাহপরীর দ্বীপ, কাটাবনিয়া, মিঠাপানিরছড়া, জালিয়াপালং, ইনানী, হিমছড়ি, রেজুখাল, কুতুবদিয়া, খুরুশকুল, চৌফলদন্ডি, মহেশখালী এলাকা হয়ে ট্রলারে মানবপাচার হয়ে থাকে।
কক্সবাজারের ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরান হোসেন বলেন, আগে অনেক মানব পাচার হতো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় বিষয়টি এখন অনেক কমে এসেছে।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, এই এলাকায় মানবপাচার চক্রটি সব
সময়ই সক্রিয়। তবে আমরা তা রুখে দিয়েছি। কিন্তু ওরা সুযোগের সন্ধানে বসে থাকে। বিশেষ করে রোহিঙ্গারা নানান অপরাধে জড়িয়ে যায়। তারা মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে, আমরাও করছি। এই ধরনের খবর পেলে বা সন্দেহ হলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, এখানে নিয়মিত মামলা হয়। আমরা কমিউনিটি ও বিট পুলিশিং করে থাকি। কারা এসব পাচারের সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসি। শুধু তাই নয়, কেউ যদি জামিনে বের হয়ে আসে তারপরও আমরা তাদের নজরদারি করে থাকি। তবে এই ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
র্যাব -১৫ অধিনায়ক খাইরুল আমিন সরকার জানান, আমরা দুই মাসে প্রায় দুই শতাধিক মালেশিয়াগামী রোহিঙ্গা নাগরিককে উদ্ধার করেছি। দালাল চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।