![](https://dainikbayanno.com/storage/screenshot-20220119-151655-2.png)
রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধের একদিকে চলছে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ। আর অন্যদিকে চলছে বাঁধ দখলের মহোৎসব। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, বাঁধের কোল বিক্রয় হচ্ছে। সেখানে অবৈধ ভাবে গড়ে উঠছে নানা স্থাপনা। দখলে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে শহর রক্ষা বাঁধ। পশ্চিমের শ্রীরামপুর থেকে শুরু হয়ে পূর্বে শ্যামপুর পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার জুড়ে চলছে দখলের কারবার।
এর আগে বাঁধের নীচে পাঠানপাড়া এলাকায় সিটি কর্পোরেশন দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা গড়েতোলে নগরবাসীর বিনোদনের জন্য। বড়কুঠি ও ফুদকীপাড়া এলাকায় নানা স্থাপনা করে বিনোদনের ও বাঁধ তীর সুরক্ষা করেছে। একটু ফুরসত পেলে নগরবাসী ছুটে যান পদ্মার এসব স্পটে। সিটি কর্তৃপক্ষ পদ্মার তীর ঘেঁষে ও বাঁধের উপর পাকা রাস্তা করে দিয়েছে সাধারণ মানুষ যাতে পায়ে হেঁটে বা সকাল বিকেল বায়ু সেবন করতে পারে। বাঁধের উপর দিয়ে যাতে যানবাহন চলাচল করতে না পারে সেজন্য পিলার দিয়ে ব্যারিকেডও করা হয়। শাহমখদুম কলেজ হতে তালাইমারী শহীদ মিনার পর্যন্ত বাঁধের উত্তর কোলে পনের লাখ টাকা খরচ করে বাঁশ আর নেটের বেড়া দিয়ে গড়ে তোলা হয় নজরকাড়া বাগান।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহরে ঢোকার আগে দৃষ্টিনন্দন এ বাগান নজর কাড়ত। কিন্তু এসব কিছু অবৈধ দখলদার কোপানলে পড়ে শেষ হয়েছে। বাঁধের উপর রাস্তার পিলার নেই। চলে সাইকেল মটরসাইকেল অটোরিক্সা। শ্যামপুর এলাকায় বালির ট্রাক দাপিয়ে বেড়ায়। বড়কুঠি থেকে শ্যামপুর পর্যন্ত শহর রক্ষা বাঁধ সরেজমিন প্রত্যক্ষ করে দেখা যায় বাঁধ দখল করে গড়ে উঠছে বিভিন্ন স্থাপনা। বিশেষ করে আলুপট্টি এলাকায় দৈনিক বার্তা অফিসের পেছনে বাঁধ সংলগ্ন পুকুর দখল করে ঘরবাড়ি উঠে গেছে। অস্তিত্ব নেই পুকুরটির। শাহমখদুম কলেজ হতে তালাইমারী পর্যন্ত দখলবাজী আর বিক্রি চলছে সমানে। বাঁধের নীচে আগে পানি নিষ্কাশনের ত্রিশ চল্লিশ ফুট চওড়া ড্রেন ছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভাষায় নয়ানজুলি। সিটি কর্তৃপক্ষ এ কাঁচা ড্রেনের মধ্যে তিন ফুটের একটা পাকা ড্রেন করার পর ড্রেনের দু’ধারে ভরাট করে দখল হয়ে ঘরবাড়ি দোকানপাট উঠেছে এবং এখনও উঠছে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ স্থানীয় এবং স্থানীয় নেতাদের ছবি সম্বলিত সাইনবোর্ড দিয়ে দখল করা হয়েছে। কেউ নৈশ বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড দিয়ে ভবন নির্মাণ করে। পরে সাইনবোর্ড খুলে নিয়েছে।
দখলদারিত্বে জনপ্রতিনিধিরাও পিছিয়ে নেই। বিভিন্ন সমিতির নামেও সাইন বোর্ড ঝোলানো আছে। পঞ্চবটি হতে তালাইমারী পর্যন্ত বাজে কাজলার বড় পানির খালটি জাল দলিল করে মামলা দিয়ে দখল করার অপচেষ্টা কম হয়নি। বাঁধের উত্তর পার্শ্বের রাজশাহী-নাটোর মহাসড়ক ফোর লেন করার কাজ শুরু করেছে সিটি কর্তৃপক্ষ। এর অংশ হিসাবে বাঁধের কোল ঘেঁষে ড্রেন ফুটপাত নির্মাণ কাজ চলছে। বাঁধের উত্তর কোলে ফের দৃষ্টিনন্দন বাগান করার পরিকল্পনা রয়েছে। দক্ষিণ কোলেও পানির ড্রেনটিকে পূর্ব-পশ্চিম লম্বালম্বি লেকসহ বেশ কিছু পরিকল্পনার কথা জানালেন সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক। তিনি মাল্টিমিডিয়ায় পরিকল্পনার বিষয়টা দেখান। যেটি বাস্তবায়ন হলে অন্যরূপ পাবে বাঁধ। অন্যদিকে বাঁধও সুরক্ষা হবে। সামাজিক পরিবেশের উন্নয়ন হবে। কেননা এখন বাঁধের উপর হাঁটতে গেলে পাওয়া যায় গাঁজার উৎকট গন্ধ। বাঁধের নীচের বস্তিতে রয়েছে মাদকের আখড়া। ছিনতাইকারী মাস্তানদের নিরাপত্তার আশ্রয়স্থল। সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অবৈধ দখলের কারণে কোন কিছু ঠিক রাখা যাচ্ছেনা। সিটি কর্পোরেশন যে উদ্যোগ নিয়েছে তা সফল করার ক্ষেত্রে এসব অবৈধ দখলদাররা বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
বাঁধের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, পদ্মার ভাঙ্গন থেকে শহর রক্ষার জন্য ১৮৫৫ সালে শ্রীরামপুর এলাকায় প্রথম বাঁধ নির্মাণ হয়। এরপর ১৮৭১ সাল পর্যন্ত পর পর বন্যা ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষার জন্য পশ্চিমে প্রায় দশ কিলোমিটার পর্যন্ত বাঁধ সম্প্রসারণ করা হয়। এ শহর রক্ষা বাঁধ শহরকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করেছে। রামচন্দ্রপুর এলাকায় প্রবীণ ব্যক্তি পৌরসভার সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আনোয়ার কামাল, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আকবর আলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের চরম অবহেলার কারণে বাঁধের এমন বেহাল দশা। একটা সময় ছিল বাঁধে গরু-ছাগল উঠা পর্যন্ত নিষেধ ছিল। প্রতিদিন প্রহরী বাঁধের উপর টহল দিত। বাঁধের উপর চলাচল ছিল সংরক্ষিত। সাইনবোর্ড টানিয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। ইঁদুরে গর্ত করে বাঁধের ক্ষতি করল কিনা এসব প্রতিবছর খতিয়ে দেখা হতো। প্রয়োজনীয় সংস্কার হতো। বাঁধের নীচের পানির আধারটি মাছ চাষের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড লীজ দিত। এখন সবই দখলে চলে গেছে। তারা বলেন, এ বাঁধটি এখনো বন্যার হাত থেকে শহর টিকিয়ে রেখেছে।
পদ্মা মরে গিয়ে তার বুকে উঁচু বিশাল বালিচর পড়ছে। বিপদের কথা হলো পদ্মারচর থেকে শহরের মাটি চার পাঁচ ফুট নীচে। সারা বছর পদ্মায় পানি না থাকলেও ফারাক্কার ওপারের বন্যা সামলাতে সবক’টি গেট খুলে দেয়। তখন মরা পদ্মাও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। বরং আগের চেয়ে এখন ঝুঁকি বেশী। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সব কাগজপত্র থাকা সত্তে¡ও নির্মাণ করতে গেলে বিভিন্ন দপ্তর থেকে ভোগান্তি পোহাতে হয় বিদ্যুত পানি সংযোগ নিতে। অথচ বাঁধের উপর স্থাপনাকারীদের কেউ কিছু বলে না। বিশেষ সমঝোতায় পানি বিদ্যুত ভবন সব হয়ে যায়। যে বাঁধ নিয়ে এত কথা সেই বাঁধের মালিক পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সবাই দুষছেন বাঁধের এ বেহাল দশার জন্য। তাদের কারো কারো সাথে বিশেষ সমঝোতা ছাড়া এমন দখলবাজী সম্ভব নয়। বরাবর পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙ্গা রেকর্ডের মত দায়সারা রেকর্ড বাজিয়ে বলেন, আমরা অবৈধ তালিকা করেছি। ২০১৫ সালে দখলদারদের পনের দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে তা সরানোর নোটিশ দিয়েছিল। কিন্তু ঐ পর্যন্ত। কেউ অবৈধ স্থাপনা সরায়নি। বরং আরো বেড়েছে। ২০০৭ সালে যৌথ বাহিনী বাঁধের উপরকার সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছিল। পরবর্তীতে পানি উন্নয়ন বোর্ড তা ধরে রাখতে পারেনি। এই না পারাকে সর্ষের মধ্যে ভূত আছে বলে অনেকে মন্তব্য করেন। শহর রক্ষা বাঁধের উপর বিজিবি রেস্তারাঁ তৈরী করার পর মালিকানা নিয়ে বিজিবি ও জেল পুলিশ মুখোমুখি। পানি উন্নয়ন বোর্ড রাজশাহী অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলীর কথা হলো বাঁধের উপর কোন স্থাপনা আইন অনুযায়ী বৈধ নয়। আমরা অবৈধ দখলদারি থেকে বাঁধ রক্ষা করব। ইতোমধ্যেই তিনশ’ জনের একটি তালিকা করা হয়েছে। এজন্য তারা পুলিশী সহায়তা চেয়ে পুলিশ কমিশনারের কাছে চিঠি দিয়েছেন। পুলিশী সহায়তা পেলে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে। উল্লেখ্য, এর আগেও ঐ পদে যারা ছিলেন তারাও একই রকম কথা বলেছিলেন গণমাধ্যম কর্মীদের। কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।