ঢাকা, শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

রোগী ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি নাকি স্বাস্থ্য অধিদফতরের উদাসীনতা?

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২২ ১১:৩৩:০০ পূর্বাহ্ন | স্বাস্থ্য

 

গত ১৪ জানুয়ারি করোনা পজিটিভ শনাক্ত হন নাসরীন জাহান। একে একে করোনাতে সংক্রমিত হন তার পরিবারের আরও তিনজন। মোট চারজনের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে মাত্র একজনকে টেলিফোন করা হয়েছে। জানতে চাওয়া হয়েছে, তিনি কেমন আছেন, টিকা নিয়েছেন কিনা। এই পরিবারের বাকি তিন সদস্য অধিদফতর থেকে ফোন পাননি।

আবু হাসান করোনায় আক্রান্ত হন ১১ জানুয়ারি। তার স্ত্রী জোহরা শিউলি তারপর দিন। তারাও স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে ফোন কল পাননি।

গণমাধ্যমকর্মী ইশরাত জাহান ঊর্মি করোনাতে আক্রান্ত হন গত ২২ জানুয়ারি। আরেক গণমাধ্যমকর্মী শেরিফ আল সায়ার করোনার পজিটিভ রিপোর্ট পান ১১ জানুয়ারি। নুরেম মাহপারা প্রাপ্তি পজিটিভ হন ১৮ জানুয়ারি। ঊর্মি, শেরিফ কিংবা প্রাপ্তি তারা কেউ স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে ফোন কল পাননি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি ঢাকায় কোভিড ডেডিকেটেড  সরকারি হাসপাতালের ৩ হাজার ১৪৫ বেডের মধ্যে ২ হাজার ৮৬৫টি বেড খালি ছিল। ফেব্রুয়ারির ১ তারিখের হিসাবে দেখা যায়, ঢাকার সরকারি হাসপাতালে ৩ হাজার ৫৪৬ বেডের মধ্যে ২ হাজার ৫৮১ বেডই খালি। অপরদিকে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ১ হাজার ৬৩৯ বেডের মধ্যে ১ হাজার ২৮৪ বেডই খালি রয়েছে। একই অবস্থা আইসিইউ বেডগুলোরও। তবে বেশকিছু সরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে নন-কোভিড রোগীতেই বেড ভর্তি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া সর্বশেষ তথ্য বলছে, ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোর ৭৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেডই খালি রয়েছে। আর আইসিইউ বেড ফাঁকা আছে ৬৫ শতাংশ। বেসরকারি হাসপাতালের ৭৮ শতাংশ বেড এবং ৭৫ শতাংশ আইসিইউ বেড ফাঁকা আছে।

উল্লেখ্য, সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ঢাকায়। আবার ঢাকার সরকারি-বেসরকারি  হাসপাতালের খালি বেডের পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা যায় যে, করোনা শনাক্তদের  বেশিরভাগই বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন।

ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা অনেক কম। যারা আসছেন তাদের তীব্রতা কম। যাদের আইসিইউ লাগছে তাদের কোমরবিডিটি আছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর জানাচ্ছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ( ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা) করোনাতে রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৯ হাজার ৩৬৯ জন। আর এ সময়ে আইসোলেশনে আছেন এক হাজার ৬২৪ জন আর কোয়ারেন্টিনে আছেন তিন হাজার ৭৯১ জন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাতে আক্রান্ত হলে তাদের আইসোলেশন, তার সংস্পর্শে আসাদের কোয়ারেন্টিন, বাসায় থাকলে তার জন্য কোনও ওষুধ দরকার হলে তার পরামর্শ দেওয়া অর্থাৎ রোগী ব্যবস্থাপনাসহ নানা বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে।

কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতর সেটা করছে না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের এ অবস্থাকে তাদের রোগী ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি নাকি এটা তাদের উদাসীনতা এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

বারবার রোগী ব্যবস্থাপনায় সঠিক আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনের গুরুত্ব নিয়ে বলেছি জানিয়ে কোভিড-১৯ বিষয়ক কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, স্থানীয়ভাবে এ জন্য একটি কমিটি করার কথা বলা হয়েছিল।

সিটি কর্পোরেশনের ভেতরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে (কাউন্সিলর) প্রধান করে একটি কমিটি থাকবে।  সেখানে আরও থাকবেন ধর্মীয় প্রতিনিধি, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, স্বেচ্ছাসেবীরা। তারা বাসায় যেসব রোগী থাকছেন তাদের চিকিৎসা, আইসোলেশন হচ্ছে কিনা সব বিষয়ে কোঅরডিনেট করবেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে সমন্বিতভাবে।

“কিন্তু এটা কেউ করছে না, ভীষণভাবে মিসম্যানেজমেন্ট হচ্ছে চারিদিকে”। তিনি বলেন, স্থানীয় কমিটি দরকার হলে হাসপাতালে নিয়ে যাবে, বাসায় থাকলে তার ব্যবস্থাপনা করবে, এমনকি বাসায় কেউ না থাকলে পরিবারের জন্য বাজার পর্যন্ত করে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু এসবের কিছুই হয়নি।

এক ঘরের ভেতরে একজনকে ফোন করলো, সেটাও ঠিকভাবে নয়, আবার বাকিদেরও করলো না, এটা কোনও কথা হলো?—প্রশ্ন করে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, সবকিছু ‘হ্যাপাজার্ডলি’ চলছে, কোনওরকমে।

অথচ মহামারি নিয়ন্ত্রণে রোগী ব্যবস্থাপনার জন্য একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক দরকার হয়, সেই নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়ে তিনি বলেন, এগুলো বহুবার বলা হয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবচিত্র আমরা গত দুই বছরেও দেখতে পাইনি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে সবাই বলেছে, রোগী ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল বলেন, অধিদফতর থেকে যে একজনকে ফোন করে খোঁজ নেওয়া হয়েছে সেটাই অনেক, তার অনেক ভাগ্য যে তিনি ফোন কল পেয়েছেন।

ওমিক্রনের ঊর্ধ্বগতিতে প্রায় ৯৯ শতাংশই বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন, যেহেতু সবার ক্ষেত্রে এটা ডেল্টার মতো জটিলতা তৈরি করছে না। আর হাসপাতালের বাইরের রোগীদের কী অবস্থা, তার কোনও সেবা দরকার রয়েছে কিনা, তাকে কোনও উপদেশ দেওয়ার দরকার রয়েছে কিনা—এটা অবশ্যই স্বাস্থ্য অধিদফতরকে দেখতে হবে, এটা তার দায়িত্ব-বলেন তিনি।

যখনই কোনও রোগী করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দেয়, তখনই অধিদফতর তার নাম-ঠিকানা-ফোন নম্বর নিয়ে নেয়। তাহলে কেন তারা এটা করছে না—প্রশ্ন করে আবু জামিল ফয়সাল বলেন, এটা বড় ধরণের উইকনেস, ইনএকুইয়িটি।

স্বাস্থ্য অধিদফতর কেবল মনে করে, রোগী হাসপাতালে এলে দেখাশোনা করবো, এর জন্য তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটা ঠিক নয়। দেশের প্রতিটি নাগরিক, তিনি হাসপাতাল অথবা বাসা—যেখানেই অবস্থান করুক তার দেখাশোনা, তার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় পরার্মশ দেওয়াও অধিদফতরের অন্যতম দায়িত্ব। এবং মহামারি নিয়ন্ত্রণে এটা বিশাল ভূমিকা রাখবে মন্তব্য করে আবু জামিল ফয়সাল বলেন, এটা সম্পূর্ণভাবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগী ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, রোগী ব্যবস্থাপনার বিকল্প কিছু নেই।

“পরিবারের ভেতরে কে আইসোলেশন আর কে কোয়ারেন্টিনে যাবে, পরিবারের একজন পজিটিভ শনাক্ত হলে বয়োজ্যেষ্ঠদের কী অবস্থা হবে, রোগী কী ওষুধ খাবে তার খোঁজ নেওয়া এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ”। মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, প্রতিটি রোগীর ফলো-আপ দরকার। সেই সঙ্গে যারা উপসর্গহীন রয়েছেন তাদেরকে পরীক্ষা করাতে উৎসাহিত করা। রোগী ব্যবস্থাপনা এবং রোগী শনাক্তে সাহায্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্যান্ডেমিকের সময় বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে কখনো অবহেলা করা যাবে না—এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে, বলেন ডা. মুশতাক হোসেন।