ঢাকা, শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

রোহিঙ্গা শিবিরে কঠোর নিরাপত্তার বলয়

স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার // | প্রকাশের সময় : রবিবার ২৮ নভেম্বর ২০২১ ০৩:০৬:০০ পূর্বাহ্ন | জাতীয়
সময় যত যাচ্ছে  ততই  আতঙ্কের জনপদ হিসেবে  রুপ নিচ্ছে রোহিঙ্গা শিবির । রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের  অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অস্থির হয়ে উঠেছে  সাধারণ রোহিঙ্গারা। এরই মধ্যে ক্যাম্পে ঘটে যায় রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড এবং সিক্স মার্ডারের মতো নৃশংসতা। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগের চেয়েও কঠোর হয়েছে। তাদের সঙ্গে সেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে রোহিঙ্গা সেচ্ছাসেবীদের। এসব সেচ্ছাসেবীরা লাঠি হাতে রাতে পালা করে পাহারা দিচ্ছেন। এবার তাদের মুখে দেওয়া হল বাঁশিও। আর এতেই পাল্টে যাচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা পরিস্থিতি। ফিরে এসেছে স্বস্তি।
 
এই বদলের মূলে রয়েছেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)-৮ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রবিউল ইসলাম। এপিবিএন-৮ এর অধিনায়কের সঙ্গে পরামর্শ করে নিজের সৃজনশীল চিন্তার মাধ্যমে নানান নতুন উদ্যোগে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তায় যুক্ত করেছেন ভিন্ন মাত্রা। তার এই কাজ এরইমধ্যে বিভিন্ন মহলে প্রসংশা কুড়িয়েছে।
 
উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জরাকীর্ণ ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ রোহিঙ্গারা যদি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার আগেই সেই তথ্য প্রশাসনকে জানিয়ে দেয়, এতে সেখানে বড় ধরনের কোনো অঘটনের আশঙ্কা থাকবে না।
 
 রোহিঙ্গা বাসিন্দা ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উখিয়ায় সিক্স মার্ডারের পর গত ২৩ অক্টোবর প্রথমে শফিউল্লাহ কাটা (ক্যাম্প-১৬) ও জামতলী ক্যাম্পে (ক্যাম্প-১৫) রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে নিজ নিজ এলাকা রাতের পাহারার আয়োজন করে এপিবিএন-৮ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রবিউল ইসলাম। এরপর চলতি মাসের ১০ নভেম্বর থেকে উখিয়ার সব ক্যাম্পে এই পদ্ধতি চালু করে নিরাপত্তা ছক সাজানো হয়। উখিয়ায় মোট ১১টি ক্যাম্পের ব্লক ৬৪টি আর সাব-ব্লক ৭৭৩টি। এসব ক্যাম্পে ৩ লাখ ৬২ হাজার ২১৮ জন রোহিঙ্গার বসবাস। শুধু জামতলী ক্যাম্পে আছে ৫৩ হাজার ৪৬০ জন। প্রতিদিন ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে গড়ে পাহারাদার ৩ হাজার ৮০০ জন। রোটেশন অনুযায়ী ১৫ থেকে ২০ দিন পর পর একেকজনের পাহারার দায়িত্ব পড়ে। মোট পাহারা পোস্ট ১০১টি। প্রত্যেক পাহারাদার টিমের দলনেতার মোবাইল নম্বর পুলিশের কাছে রয়েছে। আবার তাদের কাছেও পুলিশের নম্বর রয়েছে। কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার আভাস পেলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করেন তারা।
 
উখিয়ার জামতলীর বি ব্লকের মাঝি নুরুল ইসলাম বলেন, রাত ৮টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত সবাই মিলে পাহারা দিচ্ছি। ভয়ে কোনো খারাপ লোক এলাকার ঢোকার সাহস পাচ্ছে না। প্রথমে শুধু হাতে লাঠিসোটা নিয়ে পাহারা দিতাম। এখন বাঁশিও পেয়েছি। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাত ৮টার ৪০ মিনিটে কুতুপালং ক্যাম্পে নিজ কার্যালয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহকে। এরপর ২২ অক্টোবর রাতে উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা আল-ইসলামিয়া মাদ্রাসায় সিক্স মার্ডারের ঘটনা ঘটে। এরপরই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রাতের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্যাম্পে টহল জোরদার করে। এর পাশাপাশি রাতে শুরু করে ব্লক অভিযান।
 
রোহিঙ্গা মাঝি বাছেদ বলেন, কিছু লোকের কারণেই ক্যাম্পের পরিবেশ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। কথা না শুনলে ওরা একে-ওকে মারধর করে। মাসখানেক আগেই এইচ ব্লকে এক তরুণীর ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তাকে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের একটি গ্রুপ। এতে রাজি না হওয়ায় তার এ পরিণতি। বাছেদ আরও বলেন, অনেকে আরসার নাম ভাঙিয়ে ভয় দেখানোরও চেষ্টা করে। ছলিম নামে একজন নিজেকে জামতলীর চারটি ক্যাম্পের রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কমান্ডার বলে দাবি করত। তারা আশপাশের এলাকা প্রায় জিম্মি করে রেখেছিল। সন্ধ্যা নামলেই তাদের উৎপাত বাড়তো। তবে এখন সাধারণ রোহিঙ্গারা এসব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে রুখে দিচ্ছে। মাসখানেক ধরে রাতে ক্যাম্পে পালাক্রমে সাধারণ রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। নিজ এলাকায় যারা নিরাপত্তা দিচ্ছেন তাদের প্রত্যেকের হাতে থাকে লাঠি। রাতে কেউ আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করলে তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেন স্বেচ্ছাসেবীরা। এরই মধ্যে জামতলী ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী মৌলভী মনির, ছলিম, ইয়াহিয়া, ইমাম হোসেন, মৌলভী নাসিরকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেন স্বেচ্ছাসেবীরা। এরপর থেকে ক্যাম্পে অনেকটাই স্বস্তির পরিবেশ ফিরে এসেছে। গতকাল এপিবিএন -৮ এর অধীন ১১টি ক্যাম্পে অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) মোহাম্মদ সিহাব কায়সার খান শফিউল্লাহকাটা ও জামতলী পুলিশ ক্যাম্পের দায়িত্বে ক্যাম্প কমান্ডার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রবিউল ইসলাম রোহিঙ্গা পাহারাদারদের মধ্যে বাঁশি প্রদান করেন।উখিয়া নিউজ ডটকম।
 
অধিনায়ক মোহাম্মাদ সিহাব কায়সার খান বলেন, আমাদের আওতাধীন ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির রোহিঙ্গা সদস্যের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। তারা আমাদের প্রবর্তিত স্বেচ্ছা পাহারা ব্যবস্থার প্রতি সম্মান রেখে প্রতিদিন রাতে পাহারা দিচ্ছে। এতে পুলিশ ও সেচ্ছাসেবীদের মধ্যে সহযোগিতার সর্ম্পক সৃষ্টি হয়েছে। দুষ্কৃতিকারীরা একের পর এক গ্রেফতার হচ্ছে এবং অনেকে গা ঢাকা দেয়। এই পাহারা ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য সদস্যরা দায়িত্বশীল হয়ে উঠে। বিভিন্ন মহলেও এ ব্যবস্থা প্রশংসিত হচ্ছে।
 
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রবিউল ইসলাম বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সংশ্লিষ্ট কমিউনিটিকে যুক্ত করা পুলিশের একটি স্বীকৃত পদ্ধতি। এখান থেকেই রোহিঙ্গা সেচ্ছাসেবীদের দিয়ে রাতের পাহারার চিন্তা করি। তারপরের বিষয়টি তো সবাই দেখছেন। প্রথমে শফিউল্লাহ কাটা ও জামতলী ক্যাম্পে সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রথমে নিজ নিজ এলাকার নিরাপত্তা রক্ষায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।