নোয়াখালী-৪ (সদর-সুবর্ণচর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী ১৭ বছর ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। কিছু দিন আগেও তাঁর কথার বাইরে এলাকায় কিছু হতো না। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে আত্মগোপনে তিনি। অভিযোগ রয়েছে, চারবারের এমপি একরামুল গত ১৫ বছরে অনিয়ম-দুর্নীতি করে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন। কাগজে-কলমে ৩২ কোটি টাকার সম্পদ থাকার কথা তিনি বললেও আসলে তাঁর সম্পদ শতকোটি টাকার ওপর।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নোয়াখালীর কবিরহাট ও সুবর্ণচরের বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধি ছিলেন একরামুল করিম চৌধুরীর স্বজন। তাঁর স্ত্রী কামরুন নাহার শিউলি ছিলেন কবিরহাট উপজেলার চেয়ারম্যান। ছেলে আতাহার ইসরাক শাবাব চৌধুরী সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন সবশেষ উপজেলা নির্বাচনে। ভাগনে জহিরুল হক রায়হান ১৫ বছর ছিলেন পৌর মেয়র। আর ভাই হাজি মোহাম্মদ ইলিয়াস ছিলেন সুন্দলপুরের ইউপি চেয়ারম্যান। আরেক ভাই হাজি মোহাম্মদ ইব্রাহিম কবিরহাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তাঁর ভাগনে জহিরুল হক রায়হান এখন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, যদিও বছর কয়েক আগে তিনি ছিলেন পৌর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক। এভাবে নোয়াখালীর রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন একরামুল, কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন দলের অন্য নেতারা খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এমপি থাকার সময় নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নামে রাস্তা, বাজার ও স্কুল করেন একরামুল। কবিরহাটের ধানসিঁড়ি ইউনিয়নে তাঁর স্ত্রীর নামে হয় ‘শিউলি একরাম উচ্চ বিদ্যালয়’, সুবর্ণচরের চরক্লার্ক ইউনিয়নে ‘একরামুল করিম বাজার’ এবং চরজুবলি ইউনিয়নে ‘একরাম নগর’। পূর্ব চরবাটা ইউনিয়নে হয় ‘শিউলি একরাম বাজার’। এ ছাড়া, চরক্লার্কে ‘শাবাব চৌধুরী ঘাট’ ও চরজব্বর ইউনিয়নে ‘শাবাব নগর’ বানান তিনি। মোহাম্মদপুর ইউনিয়নে ডেস্টিনি কলেজের নাম বদলে করা হয় ‘একরামুল করিম চৌধুরী কলেজ’। তবে গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর এসব স্থাপনার নাম পাল্টে দিয়েছে স্থানীয়রা।একরামুল করিম ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-৫ (কোম্পানীগঞ্জ-কবিরহাট) আসনে ওবায়দুল কাদের ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বিপক্ষে নির্বাচন করেন। ভোট পান ৩৪ হাজার। তখনই আলোচনায় আসেন তিনি। তবে ক্ষমতা পোক্ত করেন ২০০৮ সালে। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নোয়াখালী-৪ আসনে সেবার এমপি হন তিনি। এর পর এই আসনে আরও তিনবার এমপি হন।যেখানে ভোট, সেখানেই একরামুলের স্বজন: স্থানীয়রা জানায়, যখন যাকে মনে হয়েছে তাকেই দলীয় পদ দিয়েছেন কিংবা জনপ্রতিনিধি বানিয়েছেন একরামুল করিম। যেমন– তাঁর চাচাতো ভাই নুরুল আমিন রুমি ছিলেন সুন্দলপুর ইউপির চেয়ারম্যান। কিন্তু পরে তাঁকে বাদ দিয়ে বড় ভাই মোহাম্মদ ইলিয়াসকে সেখানে চেয়ারম্যান বানান একরামুল। রুমিকে কবিরহাট উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। ওই পদে আসেন একরামুলের বড় ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহিম। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে গত মে মাসে ছেলে শাবাব চৌধুরীকে তিনি সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান প্রার্থী করেন। ভোটে জয়ী হন শাবাব। এ ছাড়া, গত ১৫ বছর কবিরহাট পৌরসভার মেয়র ছিলেন তাঁর ভাগনে জহিরুল হক রায়হান। এখন তারা কেউই এলাকায় নেই। অর্থ-সম্পদ বাড়ে রকেট গতিতে’: জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এইচ এম খায়রুল আনাম চৌধুরী বলেন, ‘শুধু রাজনৈতিক আধিপত্য নয়, এমপি হওয়ার পর একরামুলের সম্পদ বেড়েছে রকেট গতিতে।’ নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, ২০০৮ সালে তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ছিল ১১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার। ২০১৪ সালে ওই সম্পদ বেড়ে হয় ১৯ কোটি ৪০ লাখ টাকার। ২০১৮ সালে তা আরও বেড়ে হয় ৩৪ কোটি ৬২ লাখ টাকার। আর ২০২৩ সালে জমা দেওয়া সর্বশেষ হলফনামা অনুযায়ী, একরামুল করিমের মোট সম্পদ ৩২ কোটি ৫৯ লাখ টাকার, যার মধ্যে স্থাবর ৭ কোটি ৪৩ লাখ ও অস্থাবর ২৫ কোটি ১৬ লাখ টাকার। নোয়াখালী-চট্টগ্রামে পাঁচ বাড়ি: ২০০৮ সালের হলফনামায় একরামুল করিম তাঁর ১ কোটি ৫ লাখ টাকার একটি বাড়ি ও ৮৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকার একটি দালান রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। ২০১৪ সালে তাঁর আবাসিক ও বাণিজ্যিক দালান বেড়ে হয় ৩টি, যার দাম ৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে নোয়াখালী-চট্টগ্রামে পাঁচটি বাড়ি থাকার কথা উল্লেখ করেন একরামুল, যার দাম ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। ২০২৩ সালে তিনি আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের মূল্য দেখান ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা ও বাড়ির মূল্য ১৩ কোটি ৩২ লাখ ১৫ হাজার টাকা।নগদ টাকা বেড়েছে ১৫৮ গুণ: এমপি হওয়ার প্রথম পাঁচ বছরে একরামুল করিম চৌধুরীর নগদ টাকা বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। ২০০৮ সালে তাঁর হাতে নগদ ছিল ৩ লাখ ৩৭ হাজার টাকা, যা ২০১৪ সালে বেড়ে হয় ৫ কোটি ৩৩ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এ হিসাবে পাঁচ বছরে নগদ টাকা বাড়ে ১৫৮ গুণ। ২০০৮ সালে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাঁর জমা ছিল ৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয় ৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এ হিসাবে এমপি হওয়ার পর ১০ বছরে তাঁর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা বেড়েছে ৫৮ গুণ।স্ত্রীর সম্পদ গেল কোথায়: ২০০৮ সালে একরামুল করিম তাঁর নিজের পাশাপাশি স্ত্রী কামরুন নাহার শিউলির সম্পদ হলফনামায় উল্লেখ করেন। কিন্তু এর পর আর কোনো হলফনামায় স্ত্রীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের কথা উল্লেখ নেই। ২০০৮ সালে তাঁর স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদ ছিল ৭৫ লাখ টাকার ও স্থাবর ৩৬ হাজার টাকার। অথচ ২০১৮ সালে কবিরহাট উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় কামরুন নাহার শিউলি হলফনামায় ৩ কোটির বেশি টাকার সম্পদ থাকার কথা উল্লেখ করেন। টেন্ডার ও চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট: অভিযোগ রয়েছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, এলজিইডি ও পিডব্লিউডির টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে একরামুল করিমের ছিল নিজস্ব বাহিনী। এই বাহিনীর নেতৃত্ব দেন তাঁর ভাগনে রায়হান, চাচাতো ভাই নূরুল আমিন রুমি, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল ওয়াদুদ পিন্টু ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মাহমুদুর রহমান জাবেদ। এই বাহিনী নোয়াখালীর ফোর লেন প্রকল্প ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার উন্নয়ন কাজে চাঁদা নেয়। এলাকায় চলাচলকারী চার হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে তারা চাঁদা তোলে। সিন্ডিকেটে আরও ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সামসুদ্দিন জেহান, জিয়াউল হক লিটন, আব্দুল মমিন বিএসসি, সহসভাপতি আতাউর রহমান মানিক ও মাহমুদুর রহমান জাবেদ ওরফে মামা জাবেদ। তারা সবাই এখন আত্মগোপনে।আসলে শতকোটির বেশি টাকার সম্পদ: সাবেক এমপি একরামুল করিমের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৩২ কোটি ৫৯ লাখ টাকার সম্পদের হিসাব দিলেও তিনি আসলে শতকোটির বেশি টাকার সম্পদের মালিক। তাঁর বোনজামাই মো. নুরুজ্জামান জানান, চট্টগ্রামের লালখানবাজার হাই লেবেল রোডে একরামুলের সাড়ে ৪ কাঠা জমি রয়েছে, যার দাম অন্তত ১৫ কোটি টাকা। সেখানে একটি বহুতল ভবন ছিল। সেটি ভেঙে নতুন ভবন তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। এছাড়া, খুলশী এলাকায় বছর তিনেক আগে তিনি একটি ফ্ল্যাট কেনেন, যেটি সম্প্রতি দেড় কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন। নগরীর এল ব্লকেও আট তলা একটি বহুতল ভবন আছে তাঁর। ভবনটিতে আছে ১৪টি ফ্ল্যাট, যার দাম অন্তত ২৫ কোটি টাকা বলে জানান স্থানীয়রা। ঢাকার ধানমন্ডীতেও একটি ফ্ল্যাট আছে একরামুলের, যার দাম প্রায় ৫ কোটি টাকা।এদিকে, কবিরহাটে একরামুল করিমের বাড়িটি পাঁচ একর জায়গাজুড়ে। এখানে আছে হেলিপ্যাড, সুইমিংপুল। পাশে একটি বাগানবাড়িও রয়েছে। জায়গাসহ বাড়িটির দাম অন্তত ২০ কোটি টাকা হবে বলে জানান স্থানীয়রা। একরামুল নিজে এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা যেসব গাড়ি ব্যবহার করেন, সেগুলোর বাজারমূল্যও কমপক্ষে ২০ কোটি টাকাচট্টগ্রাম বন্দরের ১১ নম্বর জেটিতে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করে একরামুল করিমের প্রতিষ্ঠান এঅ্যান্ডজে ট্রেডিং। এখানে তাঁর ব্যবসা অন্তত ৩০ কোটি টাকার। সব মিলিয়ে শতকোটির বেশি টাকার সম্পদের মালিক একরামুল করিম চৌধুরী। আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক পৌর মেয়র আলাবক্স তাহের টিটু বলেন, ‘একরামুল ও তাঁর পরিবারের সম্পদ শুধু দেশে নয়, বিদেশেও আছে।’
যা বলেছিলেন একরামুল করিম: অনিয়ম-দুর্নীতি করে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়ার বিষয়ে কথা বলতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় একরামুল করিমের সঙ্গে। কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায়নি, মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আগে সমকালকে তিনি বলেন, ‘পারিবারিকভাবে আমরা ব্যবসায়ী। এ কারণে সময়ের হাত ধরে সম্পদ বেড়েছে। অন্যায় করে ১ টাকার সম্পদও বাড়াইনি।’
টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন ই-টেন্ডারে যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। সিন্ডিকেট করে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ নেই। আমার কোনো অনুসারী চাঁদাবাজিতে যুক্ত নয়।’ নিজের জনপ্রিয়তায় স্বজনরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন বলে ওই সময় দাবি করেন তিনি।